—ফাইল চিত্র।
চক্রবৎ পরিবর্ত্তন্তে, দুঃখানি চ সুখানি চ। এই একটি শাস্ত্রবাক্য যে ভাবে ভারতীয় প্রশাসন মাত্রেই মান্য করে চলে, অন্যান্য শাস্ত্রবচন তার ধারেকাছেও আসতে পারে না। কেন্দ্রেই হোক, রাজ্যেই হোক, গোটা দেশ জুড়ে শাসকরা মনে করেন, সুখ ও দুঃখ সমান ভাবে মানুষকে নিতে হবে, দুঃখের ঘটনা ঘটলে অবিচলিতচিত্ত থাকতে হবে। তাই পুণ্যার্জনে গিয়ে যদি পদপিষ্ট হয়ে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়ই, চিত্ত যেন বিচলিত না হয়! এমন তো হতেই পারে, হয়েই থাকে: ভাবখানা এই। হাথরসে এই মুহূর্তে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সোয়াশো মতো, আপাতত অনুমান যে সৎসঙ্গ সভা শেষ হওয়ার পর ভক্তকুল দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ‘বাবা’কে প্রণামার্থে ছুটে আসতেই এমন কাণ্ড ঘটে গেল। বয়স্ক মানুষ, নারী, শিশু তার মধ্যে পিষ্ট হলেন, কেউ প্রাণ হারালেন, কেউ সারা জীবনের মতো ক্ষত বুকে— হয়তো দেহেও— নিয়ে প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারলেন। এবং এই ভয়ঙ্কর ঘটনার পরই শুরু হল অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের কুনাট্য। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সরাসরি দায় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন সৎসঙ্গ অনুষ্ঠানের আয়োজকদের উপর। যে অনুষ্ঠানে আশি হাজার মানুষের স্থান সঙ্কুলানের জায়গা থাকা সত্ত্বেও আড়াই লক্ষ মানুষ গিয়ে উপস্থিত হন, এবং দায়িত্বহীনতার কারণে বিপুল বিপর্যয় নেমে আসে, সেখানে আয়োজকদের দায়িত্ব সর্বাধিক বটে, কিন্তু প্রশাসনও দায় এড়াতে পারে না। কী করছিল প্রশাসন, কে তাদের বাধা দিয়েছিল এত বড় জনসমাগম যাতে সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হয়, তা দেখতে? দুর্ঘটনা ঘটার পর অন্যের ঘাড়ে দোষ না চাপিয়ে উপায় থাকে না, কেননা নিজের দোষ দেখার সৎসাহস কোনও প্রশাসনেরই নেই। তবে দুর্ঘটনার পর ওই সোয়াশো জীবনকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না, কোনও ক্ষতিপূরণেই নয়।
উত্তরপ্রদেশের হাথরস এই নিয়ে প্রথম বার জাতীয় সংবাদের শিরোনাম দখল করে নিল না। এবং এখানেই রাজ্য প্রশাসনের ‘কৃতিত্ব’। কান পাতলে শোনা যায়, উত্তরপ্রদেশের আইনশৃঙ্খলার ‘অভূতপূর্ব’ উন্নতির কথা, যা নাকি যোগী আদিত্যনাথের সক্ষম মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে সম্ভাবিত হয়েছে। কিন্তু কী সেই শৃঙ্খলা যার জন্য এক-একটি জায়গা ভিন্ন ভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন বিপর্যয়ের কারণে সারা দেশের মনোযোগ দাবি করে? কেবল দুষ্কৃতী, সমাজবিরোধী, ধর্মান্তরণকারী, গো-ব্যবসায়ী, গোমাংসভক্ষক ইত্যাদি সন্দেহে বিবিধ মানুষকে হত্যা কিংবা বেদম প্রহার কিংবা গ্রেফতারের লাঠ্যৌষধি দিয়েই কি শান্তিশৃঙ্খলা স্থিত করা যায়? হাথরসের ঘটনা একটি ধর্মস্থানের অভাবিত দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা হতে পারে, কিন্তু ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী-সহ প্রশাসনের সমস্ত স্তর অভিযোগের তিরটি যে ভাবে অন্য দিকে, বিশেষত বিরোধী নেতা অখিলেশ যাদবের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন, এতেই বোঝা যায় তাঁদের শাসকোচিত মনোভাবের সম্পূর্ণ রিক্ততা এবং মানবিকতাবোধের ভয়াবহ অভাব। এমন মুহূর্তেও তাঁরা যদি সস্তা রাজনীতির উপরে উঠে দুর্ভাগ্যপীড়িত মানুষের পাশে না দাঁড়াতে পারেন, তবে আর যা-ই হোক, রাজ্যময় শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার বড়াইটি যেন আর না করেন।
বড়াই যতই করুন, উত্তরপ্রদেশের মানুষ যে বিজেপি শাসকদের উপর সন্তুষ্ট নন, তা ভালই বোঝা গিয়েছে এ বারের জাতীয় নির্বাচনে। উত্তরপ্রদেশের পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে প্রমাণ হবে শাসকের সাফল্য ও জনতার সন্তুষ্টির পরিমাণ। কিন্তু ইত্যবসরে সেখানকার জনতা, এবং সাধারণ ভাবে ভারতীয় সমাজ বিষয়েও একটি জরুরি পর্যবেক্ষণ না করলেই নয়। ভক্তির অন্ধতা যদি এতই গভীর হয়, যেখানে নিজের কিংবা অন্যের সাধারণ নিরাপত্তাবোধটুকুও স্থান না পায়, তা হলে সম্ভবত বিশ্বের কোনও শক্তিই সেই অন্ধজনে আলো দিতে পারে না। ধর্মপরায়ণতা আর ভক্তি-অন্ধতা কখনওই এক নয়— জনতার রাজনীতিতে, জনতার সমাজে এই সত্য প্রবিষ্ট হবে কবে!