—প্রতীকী ছবি।
কাদা ছোড়াছুড়ি রাজনীতিতে যেমন চলে, অন্য কোনও পরিসরেই তেমন নয়। বিশেষ করে ভোটের আবহে রাজনীতিকদের পারস্পরিক অকথা-কুকথার আঁচও বাড়ে। জনবাদী রাজনীতিতে ‘সুভাষিত’ প্রয়োগে স্থান-কাল-পাত্রভেদ নেই, দলভেদও না— সত্তরের দশক থেকে অদ্যাবধি এ রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি এ ক্ষেত্রে একই পথের পথিক। রাজনৈতিক বিরোধীর জন্ম কর্ম বিবাহ সম্পত্তি পিতৃপরিচয় কুল মান সব কিছুর দিকে কখনও অপশব্দ ধাবিত হয় সরাসরি, কখনও ইশারা-ইঙ্গিতে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি ইঙ্গিতে অত্যন্ত আপত্তিকর কিছু কথা বলায় বিজেপির এক নেতা চরম নিন্দিত ও ভর্ৎসিত হয়েছিলেন তাঁর দলের ভিতরেই, দশ বছর আগের ঘটনা হলেও জনস্মৃতি তা ভোলেনি। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও কি ভুলেছেন? সম্ভবত না। অতি সম্প্রতি বাঁকুড়ায় একই কাজ করলেন তিনিও; নির্বাচনী সভা থেকে বিষ্ণুপুরের বিদায়ী বিজেপি সাংসদ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যে যে প্রসঙ্গ উত্থাপিত হল, যে ভাবে হল, তা আর যা-ই হোক রুচিকর নয়। বিরোধিতা যখন রাজনীতির পথ ছেড়ে ব্যক্তিগত জীবনের কাটাছেঁড়া করে, বিবাহবিচ্ছেদকে টেনে এনে ব্যক্তিগতকে জনতার মাঝে বেআব্রু করে, তখন তাকে রুচিবিগর্হিতই বলতে হয়।
ভোট ঘোষণা হয়ে গেলে নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া আদর্শ আচরণবিধি মেনে চলতে হয় নেতাদের। সেই বিধি মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, বিরোধী সম্পর্কে এ-হেন মন্তব্য আচরণবিধি ভঙ্গের মধ্যে পড়ে না। তবু প্রতিদ্বন্দ্বী দলের কারও ব্যক্তিগত জীবনের প্রসঙ্গ টেনে তাঁকে রাজনৈতিক ভাবে হেয় করা যে কদাপি কারও ‘আদর্শ আচরণ’ হতে পারে না— মুখ্যমন্ত্রীর তো নয়ই, তা বলে দিতে নির্বাচন কমিশনের রুল-বুক খুলে বসার প্রয়োজন নেই। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীর বোঝা উচিত, রাজ্যের মধ্যে বা বাইরে, শিল্প সম্মেলনেই হোক বা নির্বাচনী জনসভায়— তাঁর প্রতিটি কথা ও আচরণ সাধারণ মানুষের কানে পৌঁছয় ‘মুখ্যমন্ত্রী বললেন’ পরিচয়েই। ভোটের ঘণ্টা বেজে গেলেও, নির্বাচনী আবহে নিজের দলের হয়ে প্রচারে ব্যস্ত থাকলেও তিনি দিনের শেষে মুখ্যমন্ত্রী, সেই পদের তাবৎ মর্যাদা ও গুরুত্ব রক্ষার গুরুভারটিও তাঁরই। আবার শুধু সেই পদাধিকারী বলেই নয়, রাজ্যের শাসক তথা অভিভাবক হিসাবেও তাঁর সম্মানের হানিকারক সব কিছুই তাঁর বর্জনীয়। তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীরা শালীনতার গণ্ডি ছাড়িয়ে যায় তো যাক, তিনি নিজে তা পেরোবেন কেন? কেন ‘আপনি আচরি’ তাঁদের শেখাবেন না?
শেখা বা শেখানোর চেয়েও, আসল কথাটি হল কোনটি রাজনৈতিক আর কোনটি অরাজনৈতিক তার সীমারেখাটি বোঝা, রাজনীতির ভাষা দিয়েই রাজনৈতিক বিরোধিতা করা। বিরোধের ঝাঁঝ বাড়াতে প্রতিপক্ষের ব্যক্তিগত স্খলন বা দুর্বলতাকে হাতিয়ার করা আজকের দস্তুর হয়ে উঠছে, প্রতিটি দলের নেতৃত্বস্থানীয়রাই এই দোষে দোষী। কে অবিবাহিত, কার বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে, কে নিঃসন্তান অতএব ‘সন্তানসম’ নাগরিকদের যন্ত্রণা বুঝতে অপারগ— এই সবই দুর্বলের কুযুক্তি। ‘অসাংবিধানিক’ শব্দটি ইদানীং বহুব্যবহারে জীর্ণ, রাজনৈতিক নেতাদের বোঝা দরকার, স্রেফ অকথা-কুকথাই নয়, ব্যক্তিগতকে ক্ষুদ্র রাজনীতির স্বার্থে অপব্যবহারই চরমতম ভাবে অসাংবিধানিক।