দোল উপলক্ষে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কলকাতার বিভিন্ন রাস্তায় দেখা গেল বেপরোয়া বাইকচালকদের দাপট। ফাইল ছবি।
পশ্চিমবঙ্গের উৎসব-জীবনের সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খলতার সম্পর্কটি বেশ গভীর। প্রায় প্রত্যেক উৎসবই তা প্রমাণ করে। কিছু দিন আগেই দোল উপলক্ষে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কলকাতার বিভিন্ন রাস্তায় দেখা গেল বেপরোয়া বাইকচালকদের দাপট। পুলিশ সূত্রে খবর, রাত বারোটা পর্যন্ত ট্র্যাফিক আইনের বিভিন্ন ধারা অমান্যের অভিযোগে ৫৬৪ জন বাইকচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে মাথায় হেলমেট না থাকার জন্য ২৫৪টি মামলা রুজু করা হয়। আর মত্ত অবস্থায় এবং বেপরোয়া ভাবে বাইক চালানোর জন্য দায়ের করা হয় যথাক্রমে ৬৬টি এবং ৭৭টি মামলা। অবশ্য পুলিশের একাংশের মত, গত বারের তুলনায় এ বার দোলে শহরের পথে বেপরোয়া গাড়ির সংখ্যা কম থাকায়, হ্রাস পেয়েছে মামলার সংখ্যাও।
তবে, পুলিশের দেওয়া এই হিসাবে কতখানি ভরসা করা যায়, সে প্রশ্ন থাকেই। সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা এবং পুলিশ-প্রদত্ত পরিসংখ্যানের মধ্যে হামেশাই এক বড় ফাঁক থেকে যায়। উৎসবের পরে আইনভঙ্গকারীদের কত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বা কত জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করা হয়েছে— পুলিশের তরফ থেকে প্রথামতো তার হিসাব তুলে ধরা হয়। কিন্তু পুলিশের সামনেই কত জন অন্যায় করে, নিয়ম ভেঙে পার পেয়ে যান, সেই সংখ্যাটি জানার উপায় নেই। যে শহরের অলি-গলিতে মত্ত বাইকচালকরা দাপট দেখায়, হর্নের দৌরাত্ম্য পথচারী ও এলাকাবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তোলে, পুলিশের সামনেই ট্র্যাফিকবিধি ভাঙার হিড়িক পড়ে, সে শহরে কত জনের বিরুদ্ধে সত্যিই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়? বস্তুত, শহরের উড়ালপুল এবং জাতীয় সড়কে নানাবিধ দুর্ঘটনার মধ্যে শুধুমাত্র তীব্র গতির কারণে বাইক দুর্ঘটনার সংখ্যাটি বর্তমানে নজর কাড়ার মতো। ট্র্যাফিকের নানাবিধ আইন আছে, বাইক চালানোর সময় হেলমেট না পরলে, একই বাইকে দুইয়ের বেশি আরোহী থাকলে বা না নির্দিষ্ট গতিসীমা না মানলে কী হতে পারে, সেই বিষয়ে নাগরিকের যথেষ্ট জ্ঞানও আছে। প্রশাসনের তরফে এ বিষয়ে নিয়মিত প্রচার চলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউ যদি আইনের পরোয়া না করে, নিজের নিরাপত্তা শিকেয় তুলে সড়কপথে বেপরোয়া হতে চান, তবে সেই মানসিকতাকে কি আদৌ সুস্থ বলা চলে? কিন্তু, যেখানে প্রশাসনের শীর্ষ স্তরও অনেক ক্ষেত্রেই উৎসবের দিনে ‘ছোট ছেলেদের’ এমন ‘দুষ্টুমি’তে সস্নেহ প্রশ্রয় জোগায়, সেখানে এই মানসিকতা আদৌ ঘুচবে কি না, প্রশ্ন থেকেই যায়।
তবে সমস্যাটি কেবল বাইক আরোহীদের নয়, ‘আইন অমান্য’-এর প্রবণতাটি এখন সার্বিক ভাবে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যে কারণে আইন সত্ত্বেও বর্ষবরণ, কালীপুজো থেকে ছটে শব্দবাজির তাণ্ডব সীমা ছাড়ায়, সরস্বতী বা গণেশ পুজোয় বক্স বাজিয়ে গানের তাণ্ডব ঘুম কাড়ে এলাকাবাসীর। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন, কোনও রং না দেখে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা এবং অপরাধ ও অপরাধী সম্পর্কিত তথ্য নিয়মিত প্রকাশ করা। উৎসব মানেই উচ্ছৃঙ্খলতার ছাড়পত্র পাওয়া নয়, আইন বা শৃঙ্খলা ভঙ্গের দেদার অবকাশ নয়, নিজের আনন্দের বিনিময়ে অন্যের বিপদ ডেকে আনাও নয়। এই সাধারণ কথাটি যদি মানুষ মনে না রাখে, তবে উপায়ান্তর থাকে না— কড়া ভাবে তাকে মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটি পড়ে পুলিশ-প্রশাসনেরই উপর।