Child Marriage

অশুভ সংযোগ

এ-যাবৎ কাল বিশ্বাস করে আসা হয়েছে, দারিদ্রই স্কুলছুট এবং বাল্যবিবাহের মূল কারণ। মূলত এই ভাবনা থেকেই বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পগুলির জন্ম।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৪ ০৮:২৭
Share:

—প্রতীকী ছবি।

রাজনৈতিক নেতার অভয়বাণী কি আইনের ঊর্ধ্বে? সরকারি নিয়মও তার সামনে নতজানু? পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা সেই দিকের প্রতিই ইঙ্গিত করছে। সম্প্রতি জানা গিয়েছে, রাজ্য রাজনীতিতে সংবাদ শিরোনামে উঠে আসা সন্দেশখালিতে নেতাদের কাছে গেলেই এত দিন নাবালিকা বিয়ের ছাড়পত্র মিলত। সংবাদটি রাজ্যের পক্ষে অস্বস্তিকর, আশঙ্কাজনকও বটে। পশ্চিমবঙ্গে নাবালিকা বিবাহ প্রতিরোধে বর্তমানে চালু রয়েছে কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো সরকারি প্রকল্প। কন্যাশ্রী প্রকল্পে ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে আট হাজার কোটি টাকারও অধিক ব্যয় হয়েছে। তদুপরি, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে স্কুলগুলিতে নজরদারি চালানো হচ্ছে বলে বিভিন্ন সময়ে দাবি করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। নিঃসন্দেহে সমগ্র ভারতে এ-হেন উদ্যোগের তুলনা খুব বেশি নেই। তৎসত্ত্বেও জাতীয় স্তরের নানা সমীক্ষায় ইঙ্গিত মিলেছিল যে, পশ্চিমবঙ্গ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ভারতের অন্য অনেক রাজ্যের থেকে পিছিয়ে। কিছু দিন পূর্বে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পত্রিকা ল্যানসেট-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রও ব্যর্থতার এই তত্ত্বটিতেই কার্যত সিলমোহর দিয়ে দাবি করেছে, পশ্চিমবঙ্গে নাবালিকা বিবাহের সংখ্যা বরং বৃদ্ধি পেয়েছে।

Advertisement

কেন এই ব্যর্থতা, উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে এর সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগটি গভীর এবং দীর্ঘ। সন্দেশখালিতে যেমন প্রতিটি স্কুলে ‘কন্যাশ্রী ক্লাব’ রয়েছে, নাবালিকা বিবাহ রুখতে এই ক্লাবের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থাকার কথা বহুআলোচিত। এই অঞ্চলে নিয়ম মেনে ব্লকে মিটিং হয়। পালন করা হয় ‘কন্যাশ্রী দিবস’ও। কিন্তু বাস্তবে সবের অস্তিত্বই খাতায়-কলমে। কারণ, রাজনৈতিক প্রভাব ও নেতাদের দাপটে শিক্ষক বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষে তৎপর হওয়া সম্ভবপর হয়নি। নেতাদের অনুমতি নিয়ে কোনও অভিভাবক নাবালিকা কন্যার বিবাহ দিলে পুলিশ তা বন্ধ করার সাহস দেখাত না। নাবালিকা বিবাহের খবরও ঠিক সময়ে পাওয়া যেত না। অর্থাৎ, প্রশাসন যে উদ্দেশ্য নিয়ে পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে এতবিধ পরিকল্পনা এবং অর্থ ব্যয় করে এসেছে, রাজনীতি তৃণমূল স্তরেই সেই উদ্দেশ্যকে বানচাল করে চলেছে।

এ-যাবৎ কাল বিশ্বাস করে আসা হয়েছে, দারিদ্রই স্কুলছুট এবং বাল্যবিবাহের মূল কারণ। মূলত এই ভাবনা থেকেই বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পগুলির জন্ম। কিন্তু বাস্তবে দেখা গিয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান, হুগলির মতো অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ জেলাগুলিতে বাল্যবিবাহের হার ক্রমবর্ধমান। বরং তুলনামূলক ভাবে দরিদ্র জেলাগুলিতে এই হার হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ দারিদ্র নয়, বাল্যবিবাহের পশ্চাতের মূল কারণটি সমাজের আদি অকৃত্রিম পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, যেখানে এখনও মেয়েদের উপস্থিতিকে পারিবারিক বোঝা বলে মনে করা হয়। মেয়েদের দেহ ও মনের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আরোপই যার মূল লক্ষ্য। আশঙ্কা এটাই যে, ‘জনবাদী’ রাজনীতি সমাজের এই কু-প্রবণতা হ্রাসে বিন্দুমাত্র সচেষ্ট না হয়ে প্রশাসনিক উদ্যোগের উল্টো পথে হেঁটে সেই প্রাচীন অ-সুস্থ মানসিকতারই উদ‌্‌যাপন করছে। এবং যাঁদের হাতে নিয়ম পালনের ভার, তাঁদেরও কার্যত ঢাল-তরোয়ালহীন করে রেখেছে। পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে রাজনীতির এই অশুভ আঁতাঁত ধ্বংস না হলে, কোনও নিয়ম, প্রকল্পই বাল্যবিবাহের অবসান ঘটাবে না।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement