Prisoners

কারাগারের বার্তা

ত্রৈলোক্যনাথের আত্মজীবনীতে (জেলে ত্রিশ বছর) জেলকর্তাদের নিপীড়ন, বন্দিদের সম্মিলিত প্রতিবাদ ও তার ভয়ানক পরিণামের কথা বার বার পাওয়া যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৩ ০৫:৩৭
Share:
A Photograph of Presidency Correctional Home

প্রেসিডেন্সি জেলের কুঠরিতে সুরকি দিয়ে লিখেছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। ফাইল ছবি।

বিদায় দে মা প্রফুল্ল মনে যাই আমি আন্দামানে/ এই প্রার্থনা করি মাগো মনে যেন রেখো সন্তানে।” প্রেসিডেন্সি জেলের কুঠরিতে সুরকি দিয়ে লিখেছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। অনুশীলন সমিতির সদস্য ত্রৈলোক্যনাথ পরাধীন ভারতের নানা জেলে কাটিয়েছেন দীর্ঘ ত্রিশ বছর। প্রেসিডেন্সি জেলের নির্জন কারাবাস বা ‘চুয়াল্লিশ ডিগ্রি’-র ব্যবস্থায় তাঁর সঙ্গে অপর কুঠরিতে ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। সেখানেই ঘটে অরবিন্দের দৈবদর্শন, জীবনের মোড় পুদুচেরির আশ্রমের দিকে ঘুরে যায়। ত্রৈলোক্যনাথ যান প্রথমে আন্দামানের সেলুলার জেল, পরে মান্দালয়ে। সেখানে তাঁর পাশের সেল-এ বন্দি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ত্রৈলোক্যনাথের আত্মজীবনীতে (জেলে ত্রিশ বছর) জেলকর্তাদের নিপীড়ন, বন্দিদের সম্মিলিত প্রতিবাদ ও তার ভয়ানক পরিণামের কথা বার বার পাওয়া যায়— ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ক্ষিপ্ত শ্বেতাঙ্গ সুপারিনটেন্ডেন্টের গুলিতে এক সঙ্গে অন্তত পঞ্চাশ জন বন্দি নিহত হন ত্রৈলোক্যনাথের চোখের সামনে। কিন্তু সেখানেই কথা থেমে যায় না। জেলের অর্ধাহার, অসুস্থতা, অকারণ নিষ্ঠুরতার মধ্যেও তৈরি হয় সৌভ্রাত্র, সৃজনশীলতা, হাস্যকৌতুকের পরিসর। “আমরা সময় সময় ভারতের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বহু তর্ক করিয়াছি— ভারতবর্ষ স্বাধীন হইলে কী রূপ গভর্নমেন্ট হইবে, রাজধানী কোথায় থাকিবে, রাষ্ট্র ভাষা কী হইবে, ইত্যাদি।” জেলখানার সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক এই অদ্ভুত বৈপরীত্যের দোলাচলে বাঁধা। বিপজ্জনক অপরাধীকে বন্দি করে সমাজকে বিপদ থেকে মুক্ত রাখার জন্য জেলখানার পত্তন। আবার জেলের মধ্য থেকেই তৈরি হয় সমাজকে মুক্ত করার পথ। গান্ধীর আত্মজীবনী (দ্য স্টোরি অব মাই এক্সপেরিমেন্টস উইথ ট্রুথ), আন্তোনিয়ো গ্রামশির কারাগারের দিনলিপি (প্রিজ়ন নোটবুকস), নেলসন ম্যান্ডেলার নিজের সঙ্গে কথোপকথন (কনভার্সেশনস উইথ মাইসেল্ফ) জেলখানায় বসে লেখা। এ সব বই কত দেশ, কত প্রজন্মকে পথ দেখাচ্ছে আজও। সাহিত্য, দর্শন, ভ্রমণের বহু কালজয়ী বই লেখা হয়েছিল জেলে বসে।

Advertisement

আজও লেখা হচ্ছে। দেশের মানুষের স্বাধিকার, স্বাতন্ত্র্যের দাবি করে যাঁরা জেলবন্দি, তেমন রাজনৈতিক নেতা, সমাজকর্মী, সাহিত্যিক তো আজ কম নয়। বিশ্বের নানা দেশে কেবল কারারুদ্ধ সাংবাদিকদের সংখ্যাই তিনশো ছাড়িয়েছে, বলছে একটি অসরকারি সমীক্ষা। সর্বাধিক সাংবাদিককে জেলে ভরেছে ইরান, চিন, মায়ানমার, তুরস্ক এবং বেলারুস। জেলের সংবাদ যথেষ্ট মেলে না, তাই আমেরিকায় বন্দিদের তালিম দিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন লেখানোর একটি প্রকল্প (প্রিজ়ন জার্নালিজ়ম প্রোজেক্ট) চলছে। আরিজ়োনার এক বন্দি তাঁর প্রতিবেদনে সহ-বন্দিদের প্রশ্ন করেছিলেন, নববর্ষে কী উপহার পাঠাতে পারলে খুশি হতেন? এক বন্দি উত্তর দিয়েছেন, অতীত সম্পর্কে কোন কথাগুলো সত্য, আর কোনগুলো সত্য বলে সকলকে গিলতে বাধ্য করা হচ্ছে, তা বোঝার ক্ষমতা সবচেয়ে মূল্যবান, তাই সেটাই হত তাঁর উপহার। আর এক জন উপহার দিতে চেয়েছেন সময়, যা সকলেই আরও চায় কিন্তু কেউ যথেষ্ট ব্যবহার করে না। ‘সংশোধানাগার’ থেকে মিলেছে সমাজ সংশোধনের এমন বার্তা।

জেলে যাঁরা যাননি, তাঁদের কাছে জেল এক ভয়সঙ্কুল জগৎ, কলঙ্কের কালিতে আঁকা। যাঁরা গিয়েছেন, তাঁদের অনেকের লেখাতেই আবার দেখা যায়, জেলের অত্যাচার অস্বাচ্ছন্দ্যকে ছাপিয়ে উঠেছে একঘেয়েমির যন্ত্রণা। মেদিনীপুর জেলে বন্দি বীণা দাস লিখেছেন, “আশা নেই, উৎসাহ নেই, আনন্দ নেই, বৈচিত্র্য নেই। ভোরবেলা উঠেই মনে প্রথম কথা জাগে, কেন ভোর হল? কী করব এই শিশিরসিক্ত সোনালী সকাল দিয়ে?” জেলবন্দিদের মরিয়া বিদ্রোহ নিয়ে তৈরি হয়েছে বহু ধ্রুপদী সাহিত্য, চলচ্চিত্র। প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও অর্থহীন জীবন প্রত্যাখ্যানের প্রতীকী মূল্যও বড় কম নয়। ‘শিকলপূজার পাষাণবেদী’ জেলের বাইরেও তো কম নেই। বহু বছরের বহু অবদমন সহার পরেও নিতান্তসাধারণ মানুষেরা নিজেদের ‘বন্দি’ বলে স্বীকার করতে রাজি নয়, এ খবরে মুক্তির মহার্ঘতা ফের অনুভব করা যায়। কিন্তু সে কি কেবল নিজের মুক্তি? না কি বন্দি থাকতে থাকতে মনে জন্ম নেওয়া আরও এক বড় মুক্তির কামনা? মনে পড়ে, ফাঁসির আগে দীনেশ গুপ্ত আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে তাঁর ভাইকে চিঠি লিখেছিলেন, “শুধু এইটুকু বলিয়া আজ তোমাকে আশীর্বাদ করিতেছি, তুমি নিঃস্বার্থপর হও, পরের দুঃখে তোমার হৃদয়ে করুণার মন্দাকিনী-ধারা প্রবাহিত হউক।”

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement