—প্রতীকী ছবি।
ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) বাড়াল এনডিএ সরকার। তাতে চাষির কপালের ভাঁজ আরও গভীর হল। কৃষক সংগঠনগুলির নালিশ, কুইন্টালে মাত্র একশো সতেরো টাকা, অর্থাৎ পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি চাষির সঙ্গে নিষ্ঠুর পরিহাস। প্রতি কুইন্টাল ধানে অন্তত ৩১০০ টাকা না পেলে চাষির লাভ থাকে না, সেখানে সরকার মাত্র ২৩০০ টাকা সহায়ক মূল্য ঘোষণা করেছে। চাষিদের একাংশ স্বামীনাথন কমিটির নির্ধারিত রীতি মেনে এমএসপি নির্ধারণ করার দাবি করছেন। সরকার সে বিষয়ে উচ্চবাচ্য করছে না। কিসের ভিত্তিতে এমএসপি নির্ধারণ করছে, তা-ও ঘোষণা করছে না। কৃষক আন্দোলনের দাবি মেনে এমএসপি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে আইন পাশ করার পথেও হাঁটছে না কেন্দ্র। সেই সঙ্গে রয়েছে কিছু চিরাচরিত সমস্যা। যেমন, প্রতি মরসুমে অনেকগুলি ফসলের এমএসপি ঘোষণা করে সরকার (এ বার চোদ্দোটি), অথচ অধিকাংশেরই সরকারি ক্রয়ের ব্যবস্থা নেই। ফলে ডাল, সর্ষে বা ভুট্টার মতো ফসল চাষি এমএসপি-তে বিক্রি করতে পারে না, আর সরকারি ক্রয় নেই বলে বাজারের দামের উপর এমএসপি-র কোনও প্রভাবও পড়ে না। আবার, চাল-গমের এমএসপি থেকে লাভবান হন প্রধানত পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের চাষিরা। কারণ, তাঁদের ফসলের অধিকাংশই কিনে নেয় খাদ্য নিগম। অধিকাংশ রাজ্যে চাষিদের উৎপাদনের সামান্যই কেনে সরকার, তাই এমএসপি-র সুবিধা তাঁরা পান ছিটেফোঁটা। এমএসপি বৃদ্ধি ঘোষণা করে চাষির সহায়তা করছে সরকার, এই রাজনৈতিক দাবি তাই প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
প্রশ্নের মুখে পড়েছে এমএসপি-র দাবিও। কৃষক আন্দোলন এমএসপি-কে বাধ্যতামূলক করতে আইন চেয়েছে। প্রশ্ন হল, প্রতি রাজ্যের প্রতিটি চাষির এমএসপি পাওয়ার অধিকার যদি বা আইনসিদ্ধ হয়, তা বাস্তবে কার্যকর হবে কি? খাদ্য নিগম, কিংবা রাজ্যের সরকার আইন মেনে ফসল না কিনলে আদালতের হস্তক্ষেপে কাজ হবে, সে আশাই বা কতটুকু? এমএসপি-র সমর্থকরা দেখিয়েছেন যে, সব রকম ফসলের সরকারি ক্রয় করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা সরকারের সাধ্যাতীত নয়। এমএসপি-বিরোধীদের আপত্তি কেবল টাকার অঙ্ক নিয়ে নয়, ভারতে কৃষিকে কার্যত একটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পরিণত করার চেষ্টা নিয়ে। এমএসপি-তে ক্রয়, সারে ভর্তুকি, পিএম কিসান, ফসল বিমা, প্রভৃতি নানা সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার বছরে অন্তত ছ’লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করে। কৃষি-সহায়তার বিভিন্ন প্রকল্পে রাজ্যগুলির খরচ একত্র করলে দাঁড়ায় তার চাইতেও বেশি। বিশেষজ্ঞদের একাংশের হিসাব অনুসারে, ভারতে প্রতি হেক্টর কৃষিজমি-পিছু সরকারি খরচ অন্তত পঞ্চাশ হাজার টাকা। কিন্তু প্রায় কোনও চাষিই এক হেক্টর জমি চাষ করে পঞ্চাশ হাজার টাকা আয় করতে পারেন না। অর্থাৎ, ক্রমাগত কৃষির জন্য সরকারি টাকা জুগিয়েও চাষকে লাভজনক করা যাচ্ছে না।
ভারতে এমএসপি চালু হয়েছিল ১৯৬৫ সালে, যখন ভারত খাদ্যে স্বনির্ভর ছিল না। চাষিরা যাতে উন্নত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আধুনিক চাষে উৎসাহিত হন, বাজারে ক্ষতির আশঙ্কায় পিছিয়ে না আসেন, সেই জন্য এমএসপি ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। আজ ভারত খাদ্যে স্বনির্ভরই শুধু নয়, ধান রফতানিতে বিশ্বের শীর্ষে। তবু এমএসপি প্রয়োজন হচ্ছে। এ এক দুষ্টচক্র, যেখানে সরকারি সহায়তা প্রদান চাষিকে স্বনির্ভর করার পরিবর্তে আরও বেশি নির্ভরশীল করছে। তদুপরি, গম ও ধানের সরকারি ক্রয় বেশি বলে এই জলপিপাসু ফসলগুলির চাষ হচ্ছে বেশি। সরকারি ভর্তুকি-প্রাপ্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাড়ছে। অর্থাৎ সরকারি সহায়তা দেশকে সুস্থায়ী কৃষির লক্ষ্যে এগোতে দিচ্ছে না। অতএব সহায়তা ঘোষণার রাজনৈতিক চাল থেকে বেরিয়ে, সুচিন্তিত, সুসংহত নীতি তৈরির পথে হাঁটতে হবে সরকারকে। অংশীদার করতে হবে কৃষক সংগঠনগুলিকেও।