Education and Health

লক্ষ্মণরেখা

পনেরো থেকে উনিশ বছর বয়সি মেয়েদের ৭০ শতাংশেরও বেশি ভুগছে রক্তাল্পতায়, কুড়ি থেকে চব্বিশ বছর বয়সি ৪০ শতাংশেরও বেশি মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে আঠারোর আগেই, উনিশ না হতেই মা হচ্ছে ১৬.৫ শতাংশ মেয়ে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৩ ০৬:২৯
Share:

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, এই একুশ শতকেও বাংলার নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা আসলে পিছিয়ে-পড়ার খতিয়ান। পনেরো থেকে উনিশ বছর বয়সি মেয়েদের ৭০ শতাংশেরও বেশি ভুগছে রক্তাল্পতায়, কুড়ি থেকে চব্বিশ বছর বয়সি ৪০ শতাংশেরও বেশি মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে আঠারোর আগেই, উনিশ না হতেই মা হচ্ছে ১৬.৫ শতাংশ মেয়ে। এগুলি খেয়াল রাখা, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করাটা শাসক তথা সরকারের কাজ; পরিবার, সমাজ, ধর্ম— এই প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকাও কম নয়। তাই অনেক সময়ই সরকারি-অসরকারি নানা ‘এজেন্সি’কে দেখা যায় এদের সাহায্য নিতে। সম্প্রতি দেখা গেল, নানা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিয়ে ইউনিসেফ কিছু পুস্তিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ জৈন শিখ খ্রিস্টান ধর্মশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতির চয়নে দেখানো হয়েছে, কেন নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নতিবিধান জরুরি।

Advertisement

বাইরে থেকে দেখলে এই প্রচারকৌশলের অভিনবত্বটি বেশ ধরা পড়ে। যে সাধারণ মানুষেরা ঘরের মেয়েদের পড়াশোনা শিক্ষা স্বাস্থ্য বিয়ে সন্তান ইত্যাদি নিয়ে রাষ্ট্র বা সরকারের নির্দেশও কানে তোলেন না, সেই তাঁরাই নিজ নিজ ধর্মশাস্ত্র বা ধর্মগুরুদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নির্দেশে বাড়ির মেয়ে ও শিশুদের যত্ন নিলে ক্ষতি কী! সাম্প্রতিক অতীতেও এর উদাহরণ আছে, পোলিয়ো টিকা নিয়ে মানুষের কুসংস্কারের মোকাবিলায় ইসলাম ধর্মের মুরুব্বিদের সাহায্য নেওয়া হয়েছে, বাইরেও নানা দেশে নানা চার্চ-এর তরফে হয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে প্রচার বা সচেতনতা অভিযান।

এই সব নিশ্চয়ই ভাল, কার্যক্ষেত্রে ও পরিস্থিতিবিশেষে জরুরিও। কিন্তু সরকারের তরফে এ-হেন পদক্ষেপে কিছু সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে। ইতিহাস যুগে যুগে দেখিয়ে গিয়েছে ‘স্টেট’ ও ‘চার্চ’-এর, রাষ্ট্র ও ধর্মের ‘দ্বন্দ্ব’। দ্বন্দ্ব অর্থে এখানে সংঘাত ও সংযোগ দুই-ই, নিজস্ব গরজে একে অন্যের সাময়িক শরণাপন্ন হওয়া। রাষ্ট্র তথা সরকারকে বুঝতে হবে, নাগরিকের বাহ্যিক জীবনের যাবতীয় অব্যবস্থা মোকাবিলার কাজটি প্রথমত ও শেষ পর্যন্ত তারই; ধর্মের নয়, তার কাজ মুখ্যত নাগরিকের অন্তর্জীবন নিয়ে। অল্পবয়সি মেয়ে ও মায়েদের রক্তাল্পতা, ঋতুস্রাব, শিশুদের টিকাকরণ, স্কুলশিক্ষা ইত্যাদির মতো অতি জরুরি বিষয়ে যদি সমাজের অতি ক্ষুদ্রাংশেরও কুসংস্কার ও গড়িমসি থাকে, তা নির্মূল করতে হবে সরকারকেই, না পারলে সেই ব্যর্থতার দায়ও তাকেই নিতে হবে। জনমনে ধর্মের প্রভাব আছে বুঝে এ সব কাজে রাষ্ট্র যদি ধর্মের সাহায্য নেয়, তবে তা এক প্রকার অনুগ্রহ প্রার্থনা, এবং তার ‘প্রতিদান’ ঘিরে কিছু শর্ত তথা রাজনীতি থাকা বিচিত্র নয়। বস্তুত রাষ্ট্র ও ধর্মের নিজস্ব এক রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সম্পর্ক আছেই: ধর্মের সঙ্গে সংস্রব, অনুদান ও সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা ইত্যাদি নানা কিছুই সেই সম্পর্কের দ্যোতক ও অনুঘটক। কিন্তু সরকারকে বুঝতে হবে, সমাজের অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানের হাত মাঝেমধ্যে ধরলেও, নাগরিকের শাসন ও রক্ষার রাশটি তারই হাতে। তা অন্য কারও হাতে চলে গেলে মুশকিল, তখন ধর্মও রাতারাতি হয়ে উঠতে পারে শাসক ও শোষক। রাষ্ট্র তার নিজের কাজে কী ভাবে ও কতটা অন্য প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেবে, সে ব্যাপারে তাই সাবধানে পা ফেলা দরকার। নিজের কাজ নিজে করার শিক্ষাটি বরং শ্রেয়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement