—ফাইল চিত্র।
ডিজিটাল দুনিয়ায় ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজন, কিন্তু সেই উদ্দেশ্যে প্রণীত সাম্প্রতিক আইনটি (ডিজিটাল পার্সোনাল ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট, ২০২৩) সংবাদকে বিপন্ন করবে। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় বৈদ্যুতিন এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবকে চিঠি লিখল ভারতের সংবাদ-সম্পাদকদের প্রতিষ্ঠান, এডিটর্স গিল্ড অব ইন্ডিয়া। মূল আপত্তি: কোনও ব্যক্তির সম্পর্কিত তথ্যকে জনসমক্ষে আনতে গেলে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আগাম অনুমোদনের প্রয়োজন হয়, তা হলে তদন্তমূলক সাংবাদিকতার কোনও সুযোগই থাকবে না। দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহারে যিনি অভিযুক্ত, তিনি যে তেমন তথ্য প্রকাশের অনুমতি চাইলে খারিজ করে দেবেন, তা প্রায় অবধারিত। এই আশঙ্কা নতুন নয়। ২০১৮ সালে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছিল বিচারপতি বি এন শ্রীকৃষ্ণের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ কমিটি, তার প্রতিবেদনেই তা উল্লিখিত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ কমিটির প্রস্তাবিত আইনে তাই তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার শর্তগুলি থেকে সাংবাদিকতার উদ্দেশ্যে সংগৃহীত তথ্যকে বাইরে রাখা হয়েছিল। কেবলমাত্র এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, সাংবাদিকরা ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করবেন ন্যায্য এবং যুক্তিপূর্ণ ভাবে, তথ্যের স্বত্বাধিকারীর সুরক্ষা বজায় রেখে। জনস্বার্থেই সাংবাদিকদের এই ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা-ও উল্লেখ করা হয়েছিল ওই কমিটিতে। এর পরবর্তী দু’টি খসড়াতেও (২০১৯ এবং ২০২১) সাংবাদিকতাকে বিশেষ স্থান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে আইনটি সংসদে পাশ হল, সেখানে অপরাধমূলক কাজের নিবৃত্তির জন্য কিছু ছাড় থাকলেও, নির্দিষ্ট ভাবে সাংবাদিকতার কোনও উল্লেখ নেই।
এমন নীরব উপেক্ষায় বিস্মিত হওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী সরকারের সাম্প্রতিক আইনগুলি দেখলে স্পষ্ট হয় যে, এটাই প্রত্যাশিত। যেমন, প্রস্তাবিত ‘ব্রডকাস্টিং বিল’-এর খসড়ায় ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমকে ওটিটি-র ছায়াছবি, ইউটিউব-এর ভিডিয়োর সঙ্গে একই গোত্রে ফেলে, সরকারি নজরদারি কমিটির অধীনে রাখা হয়েছে। টেলিকমিউনিকেশনস বিল সংবাদমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমের সব বার্তাকে কার্যত ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ সরকারি নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের অধীনে এনেছে। এই আইনের শর্ত অনুসারে সাংবাদিকদের সূত্রের গোপনীয়তা রক্ষা করাও কঠিন হবে। একই সমস্যা দেখা দেবে ডিজিটাল ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইনেও, কারণ ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ সরকার যে কোনও ডিজিটাল তথ্য তলব করতে পারে। এর ফলে যে কোনও ব্যক্তি জনস্বার্থে সাংবাদিককে তথ্য সরবরাহ করতে দ্বিধা করবেন। এডিটর্স গিল্ড-এর আশঙ্কা, সংবাদ-স্বাধীনতার সূচকে ভারতের স্থান এখনই পাকিস্তান, আফগানিস্তানের পিছনে (১৮০টি দেশের মধ্যে ভারত ১৬১)। এমন একটি আইনের জেরে তা আরও নেমে যাবে।
কিন্তু সম্পাদকদের এই সংগঠনের আশঙ্কা কতটা গুরুত্ব পাবে? কিছু দিন আগে মণিপুরের সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় এডিটর্স গিল্ডকে ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’ বলেছিলেন মণিপুরের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ। সাংবাদিকতা যে সুষ্ঠু, স্বচ্ছ প্রশাসনের জন্য জরুরি, তা যে গণতন্ত্রের এক অপরিহার্য স্তম্ভ, বাক্স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান প্রকাশ, এই সত্যটিকে সব রকম ভাবে খর্ব করার চেষ্টা চলছে ধারাবাহিক ভাবে। নরেন্দ্র মোদী তাঁর দীর্ঘ শাসনকালে কোনও সাংবাদিক সম্মেলনে খোলাখুলি প্রশ্নের উত্তর দেননি, তা ছিল অশনি সঙ্কেত। এখন তাঁর সরকার একের পর এক আইন ও বিধি বলবৎ করে সাংবাদিকের প্রশ্ন করার ক্ষমতাই নষ্ট করে দিচ্ছে। নাগরিকের নিরাপত্তার সুরক্ষার যুক্তি দিয়ে বিপন্ন করা হচ্ছে সাংবাদিকদের। যা বস্তুত নাগরিকের বাক্স্বাধীনতাকেই খর্ব করছে। শাসকের নিন্দাকে মোদী সাংবাদিকের অধিকার থেকে নির্বাসন দিতে চান বলেই আশঙ্কা হয়। তাই দেশ থেকে সাংবাদিকতা পেশাটিকেই নির্বাসনে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছে।