— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
শহর কলকাতায় এক যুবকের আত্মহননকে কেন্দ্র করে জল্পনার মধ্যে শোনা যাচ্ছে নাগরিকত্ব আইনের কথাও। নিহতের বাবা জানিয়েছেন যে, সিএএ-বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকেই তাঁর ছেলে বিশেষ উদ্বিগ্ন ছিলেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই বলে অসহায় বোধ করছিলেন। এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার মধ্যে এমনতর চর্চার দুর্ভাগ্যজনক অবকাশ রয়েছে বলাই বাহুল্য— বিষয়টিকে রাজনীতির ও সমাজের কাছে আকর্ষণীয় করার চেষ্টা চলছে। তবে এ সবের মধ্যে এও ভাবতে হবে যে একটি আইনের কথা মানুষজীবনের আকস্মিক অবসানের ক্ষেত্রে আদৌ কেনই বা প্রাসঙ্গিক হতে পারে? কী সেই আইন, কত তার জোর যে এমন কথা উঠতে পারে? সাম্প্রতিক ইতিহাস বলছে, ইতিপূর্বে অন্যত্র নাগরিকত্ব এবং নাগরিকপঞ্জি ঘোষণার উদ্বেগপাকে একাধিক আত্মঘাতের ঘটনা ঘটেছে। সে দিক দিয়ে দেখলে বোঝা যায়, সত্যিই এই বিশেষ আইনটি আর-পাঁচটা আইনের মতো নয়, বরং তা আধুনিক বিশ্বে মানুষের অস্তিত্বের গভীরতম বিষয়টি নিয়ে আলোচনা বলে— যার নাম, নাগরিকতা।
ঘটনা হল, গণতন্ত্রবাদী জাতিরাষ্ট্রের যুগে, নাগরিকতা এমন এক বস্তু যা থাকলে বোঝা যায় না কত তার জোর, আর না থাকলে প্রতি পদে, বাঁচার প্রতি নিঃশ্বাসে বোঝা যায় তার ভয়ঙ্কর অমোঘতা। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা ও দেশভাগের ঐতিহাসিক মুহূর্তেই স্থির হয়ে গিয়েছিল, আগামী অনেক প্রজন্মকে এই অস্তিত্বের সঙ্কটে ছিন্নভিন্ন হতে হবে, তাদের নিজেদের এক চিলতে দোষ ছাড়াই। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, তাঁর ‘কথা শুকিয়ে গিয়েছে’। বিশ শতকের মহাদুর্নিয়তিকণ্টকিত উদ্বাস্তু-নাগরিকত্বহীনতার দীর্ঘ যন্ত্রণাময় ইতিহাস দেখার পরও একুশ শতকে ভারতে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে আজ যে সঙ্কীর্ণ রাজনীতি চলছে, তাতে সুস্থবোধসম্পন্ন নাগরিকেরও কথা শুকিয়ে যাওয়ারই কথা।
এ রাজ্যে মতুয়া সম্প্রদায় অনেক দিন ধরেই নাগরিকত্বের স্বীকৃতির মুখ চেয়ে আছেন। যদিও তাঁদের কাজচালানোর মতো জাতীয় পরিচয়পত্র আছে, যেমন ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, তবু নাগরিকত্বের স্বীকৃতির মূল্য তাঁদের কাছে আলাদা। এখন প্রশ্ন হল, নবপ্রণীত আইন যে হেতু অনাগরিকেরই নাগরিকত্ব দাবির আবেদনের কথা বলছে— সে ক্ষেত্রে ওই সব পুরনো জাতীয় পরিচয়পত্র উপেক্ষা করেই আবেদনপত্রে প্রথমে নিজেকে অনাগরিক বলে ঘোষণা করতে হবে। তাতে আবেদনকারীরা রাজি আছেন তো? এবং এক বার এমন ঘোষণা করে দিলে তার পর কোনও কারণে আবেদন খারিজ হয়ে গেলে তাঁদের কী পরিস্থিতি হবে, এ নিয়ে তাঁরা যথেষ্ট ভেবেছেন তো? অন্যত্র এ সব প্রশ্ন জোরালো ভাবে শোনা যাচ্ছে না, কিন্তু এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্নগুলি জোরদার ভাবে তুলেছেন। বাস্তবিক, অনেক দিন ধরেই তিনি এ কথা বলে আসছেন, এখন হয়তো প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতা অন্যদেরও মর্মে প্রবেশ করছে। ইতিমধ্যে মতুয়া সম্প্রদায়ের বিজেপি নেতৃবর জোরের সঙ্গে আইনের সুবিধা প্রচার করতে চাইলেও গোষ্ঠীর মধ্যেই এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব স্পষ্ট হচ্ছে, নেতারা বলছেন ভোট অবধি অপেক্ষা করতে। অসমের বরাক উপত্যকার মানুষ যেমন সিএএ অনুযায়ী আবেদন করতে ছুটছেন না, পশ্চিমবঙ্গের মতুয়ারাও সেই পথই নেবেন কি না দেখা যাক। বিজেপি নেতাদের অনেকেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে আবেদন করতে চলেছেন, আবেদনকারীকে যেন বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তানের মানুষ হিসাবে পরিচয় দিতে না হয়, তা দেখার জন্য। প্রশ্ন তবু থেকেই যায়। যে দেশের মানুষই বলা হোক নিজেকে, ভারতের নাগরিক হিসাবে তো আত্মপরিচয় দেখানো যাবে না এই আবেদনে! বাস্তবিক, নাগরিকত্ব নিয়ে এই সঙ্কটও নতুন নয়, সমাধানের অভাবও নতুন নয়। তা হলে প্রশ্ন: নরেন্দ্র মোদী সরকার কেন ভান করলেন যে উত্তর তাঁদের হাতেই আছে, আইনটিই প্রকৃত সমাধান? জনগণকে বিপথচালিত করার এই প্রয়াস— কেবলই ভোটের দিকে তাকিয়ে?