—ফাইল চিত্র।
লোকসভা নির্বাচনে কোনও কেন্দ্রে ইভিএম যন্ত্রে প্রাপ্ত ভোটের হিসাবের সঙ্গে ভিভিপ্যাটে জমা পড়া সব কাগজের হিসাব মিলিয়ে দেখার আর্জি খারিজ করে দিল সুপ্রিম কোর্ট। নির্বাচন প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছে, ফলে আদালতের এই রায়কে অপ্রত্যাশিত বলার উপায় নেই। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, মামলাটা দায়ের করা হয়েছিল এক বছরেরও বেশি সময় আগে। তার গুরুত্ব বিচার করে কেন নির্বাচন আরম্ভ হওয়ার আগেই তার বিচার সম্পন্ন হল না? উত্তরে ভারতীয় বিচারব্যবস্থার বহুচর্চিত দীর্ঘসূত্রতার কথা আসবে। লক্ষণীয় যে, আদালত ১০০% ভিভিপ্যাট স্লিপ গণনার আর্জিকে অগ্রাহ্য করলেও দু’টি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছে। এক, ইভিএম যন্ত্রের মাইক্রোকন্ট্রোলার-এ দলীয় প্রতীক লোড করার পর তা সিল করে দিতে হবে, এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হওয়ার পরও ৪৫ দিন তা রাখতে হবে; দুই, কোনও কেন্দ্রে নির্বাচনে দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানাধিকারী প্রার্থী আবেদন করলে সেই মাইক্রোকন্ট্রোলার যাচাই করে দেখার সুযোগ থাকবে। ইঞ্জিনিয়াররা যন্ত্রটি পরীক্ষা করে দেখবেন। অর্থাৎ, ইভিএম-এ কারচুপি যে হতে পারে, আদালতের রায় সেই আশঙ্কাটিকে উড়িয়ে দেয়নি, প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রতিক্রিয়ায় যতই উল্টো কথা বলুন না কেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য একটি আশঙ্কা থাকে— সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটির নিরপেক্ষতা নিয়েই যখন প্রশ্ন উঠছে, তখন পরীক্ষক ইঞ্জিনিয়ারদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে কী ভাবে? আশা করা যায় যে, প্রয়োজনে আদালত যথাযথ নির্দেশ দেবে, নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ থাকতে বাধ্য করবে।
অনেক লজ্জার মধ্যেও গণতন্ত্র নিয়ে ভারতের একটি বিশেষ গর্বের জায়গা ছিল। আজ থেকে নয়, ১৯৫২ সালের প্রথম লোকসভা নির্বাচন থেকেই ভারত গোটা দুনিয়ার সসম্ভ্রম মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল— একটি কার্যত নিরক্ষর জনসংখ্যার দেশে কী ভাবে দুনিয়ার বৃহত্তম গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াটি আয়োজিত হয়েছিল, তা নিয়ে বিস্ময় যেমন ছিল, তেমনই ছিল শ্রদ্ধাও। বহুবিধ উত্থানপতন সত্ত্বেও ভারত গণতন্ত্রের প্রতি অবিচলিত থাকতে পেরেছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সময়ে স্বাধীনতা অর্জন করা কার্যত আর কোনও দেশের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। আজ ভারত বিশ্বগুরু হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রীকে উচ্চৈঃস্বরে দাবি করতে হয়। কিন্তু, অতি নিম্ন আয়ের এই দেশটি যে চিরকাল বিশ্বসভায় তার আর্থিক সামর্থ্যের তুলনায় অধিক গুরুত্ব অর্জন করেছিল, তার অন্যতম কারণ ছিল গণতন্ত্রের প্রতি এই প্রগাঢ় নিষ্ঠা। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদী সম্ভবত প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি নেহরু যুগের চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট রাখবেন না। বহু ক্ষেত্রেই তিনি সফল। গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ বেআব্রু করে দেওয়ার ক্ষেত্রে সম্ভবত সফলতম। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে সব প্রশ্ন উঠছে, তার কোনওটিই ভারতের পক্ষে সম্মানের নয়। সমগ্র নির্বাচন প্রক্রিয়াটিকেই প্রযুক্তিগত কারচুপির মাধ্যমে পক্ষপাতদুষ্ট করে তোলা হচ্ছে, জনমানসে এই গভীর সংশয় শেষ সম্মানটুকুকেও কেড়ে নিচ্ছে।
এ-হেন সংশয়কে কেন গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন? প্রথম কথা, সন্দেহটি এই প্রথম প্রকাশিত হল না। এর আগেও একাধিক নির্বাচনে— ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনেও— অভিযোগ উঠেছিল যে, ইভিএম-এ কারচুপি হচ্ছে। অভিযোগটি যদি সর্বাংশে মিথ্যাও হয়, তা হলেও এমন সংশয় নিরসন নির্বাচন কমিশনের কর্তব্য। শীর্ষ আদালতের হস্তক্ষেপ অনেক দূরের কথা, নির্বাচন কমিশনেরই উচিত ছিল উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তা হয়নি। কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর ভারতবাসী অনুমান করতে পারেন। দ্বিতীয় কথা হল, এই নির্বাচনে শাসকদের পক্ষে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করার এতগুলি নগ্ন প্রচেষ্টা চোখে পড়ছে যে, দেশবাসীর পক্ষে নিশ্চিন্ত থাকা কঠিন। গণতন্ত্রের এ-হেন সঙ্কট ভারতে সুলভ নয়।