— ফাইল চিত্র।
লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার আগেই নির্বাচন পরিচালনার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী পশ্চিমবঙ্গে আবির্ভূত হয়েছে, এবং সেই বাহিনীর থাকার জন্য নির্দিষ্ট স্কুলগুলিতে নোটিসও পৌঁছে গিয়েছে। কলকাতার অন্তত চারটি স্কুলের শিক্ষক বা পরিচালকরা জানিয়েছেন, তাঁরা নির্দেশ পেয়েছেন এবং সেই অনুযায়ী বন্দোবস্ত করছেন। বন্দোবস্তের সহজ ও সরল অর্থ: স্কুলগুলিতে লেখাপড়ার আয়োজনে কাটছাঁট করতে হবে। শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, কিছু ক্লাস বন্ধ রেখে এবং একাধিক বিভাগকে এক সঙ্গে বসিয়ে যথাসম্ভব পঠনপাঠন চালানোর চেষ্টা করা হবে। এই চেষ্টার দৌড় কত দূর পৌঁছতে পারে, অনুমান করা কঠিন নয়। স্কুলের একটি অংশে নিরাপত্তারক্ষীরা সগৌরবে ও সশব্দে বিরাজমান হবেন আর অন্য অংশে সুষ্ঠু ভাবে লেখাপড়া চলবে? মনে রাখা দরকার, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ব্যবস্থাপনার খাতিরে বহু স্কুলেই স্বাভাবিক লেখাপড়া প্রতি বছরের মতোই ব্যাহত হয়েছে। সেই পর্ব শেষ করে সবেমাত্র পূর্ণমাত্রায় ক্লাস চালু হওয়ার সময়টিতেই এই নির্বাচনী নির্ঘণ্টের কোপ এসে পড়ল। অতঃপর গ্রীষ্মের ছুটির মরসুম, অধুনা রাজ্যের শাসকরা নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই ‘উঃ, কী গরম’ আওয়াজ তুলে যে মরসুম শুরু করে দেন এবং এক বার শুরু হলে সেই অবকাশ আর শেষ হতে চায় না। অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে স্থান দেওয়ার পরম সৌভাগ্যে যে স্কুলগুলি ধন্য হয়েছে, গ্রীষ্মের ছুটি শেষ হওয়ার আগে সেখানে আর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরবে বলে ভরসা নেই।
শেষ পর্যন্ত ক’টি স্কুলের পঠনপাঠন এই নির্বাচনী অভিযানের শিকার হবে, তা স্পষ্ট নয়। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ জানিয়েছে যে তারা এই বিষয়ে কিছুই জানে না। এই না-জানার মধ্যেই অব্যবস্থা ও অবিবেচনার মূল চরিত্র নিহিত আছে। একটিও স্কুলের শিক্ষা পরিচালনার কাজে কোনও রকমের ব্যাঘাত ঘটলেও তাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে দেখা জরুরি। অথচ শিক্ষা-প্রশাসনকে কিছুই না জানিয়ে নির্ধারিত স্কুলের কাছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর আগমন বার্তা চলে আসছে! শুধু এই ঘটনাই জানিয়ে দেয়, স্কুলশিক্ষার প্রতি শাসনব্যবস্থার চালকদের ঔদাসীন্য কোথায় পৌঁছেছে। রাজ্য প্রশাসন তথা ক্ষমতাবান রাজনীতিকদের এই ঔদাসীন্যের ধারাবাহিক পরিচয় গত কয়েক বছর ধরে— অতিমারির সময়ে এবং তার পরবর্তী পর্বগুলিতে— বিশেষ ভাবে প্রকট হয়েছে। অতিমারি-জনিত ক্ষয়ক্ষতির পূরণে বিশেষ তৎপরতা দূরস্থান, অহেতুক স্কুল বন্ধ রাখার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এই রাজ্যে দেখা গিয়েছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে বহু স্কুল দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ থেকেছে, নির্বাচনপর্ব শেষ হওয়ার পরেও সেই ব্যাঘাত শেষ হয়নি। এখন যা ঘটছে বা ঘটতে চলেছে, তা এই শিক্ষা-বিনাশী ধারাবাহিক ইতিহাসেরই নতুন অধ্যায়।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই একটি মৌলিক প্রশ্ন তোলা জরুরি। নির্বাচন স্কুলের লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটাবে কেন? কোন যুক্তিতে? স্বাধীন দেশে নির্বাচন পরিচালনার বিপুল কর্মযজ্ঞ সামলানোর জন্য প্রথম পর্বে স্কুলবাড়িগুলিকে ভোটের কাজে ব্যবহার করার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু প্রথম নির্বাচনের পরে সাত দশক কেটে গিয়েছে। আজও সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক নির্বাচনী ব্যবস্থার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড যথাযথ ভাবে চালানোর জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করা গেল না? এখনও যে কোনও ভোট এলেই সপ্তাহের পর সপ্তাহ পঠনপাঠনের ক্ষতি হবে? স্পষ্টতই, যাঁরা দেশ চালান, তাঁরা স্কুলশিক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বলে মনে করলে এমনটা হতে পারত না। গভীর উদ্বেগ এবং আক্ষেপের বিষয় এই যে, সমাজও কার্যত সেই একই ঔদাসীন্যের শিকার। ভোটের কাজে শিক্ষার ক্ষতি করা চলবে না— এমন কোনও দাবি আজও শোনা গেল না। সুতরাং, ভোট এলে লেখাপড়া শিকেয় উঠবে, এই ঐতিহ্যই চলছে এবং চলবে।