—ফাইল চিত্র।
কাহারও শুক্তিতে রজতভ্রম হইলে তাহা কেবল ভ্রান্তির নিদর্শন নহে, লোভেরও নিদর্শন। রুপার প্রতি মানবহৃদয় প্রলুব্ধ না হইলে ঝিনুকের প্রতি সহসা ধাবিত হইত না। সর্পকে ভয় পাইবার জন্যই রজ্জুতে সর্পভ্রম হইয়া থাকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে অকর্তব্যকে কর্তব্য বলিয়া মনে করিলেন— মুখ্যমন্ত্রীদের অবহিত না করিয়া সরাসরি বিভিন্ন রাজ্যের জেলাশাসকদের বৈঠকে ডাকিয়া বসিলেন— তাহার মূলেও কি এমনই কোনও আবেগ রহিয়াছে? রাত না পোহাইতে সিদ্ধান্ত বদল করিয়া মুখ্যমন্ত্রীদেরও বৈঠকে আহ্বান করিল কেন্দ্র, কিন্তু প্রশ্নটি রহিয়া গেল। নিজের তৎপরতা প্রমাণ করিবার লোভে মোদী জেলাশাসকদের বৈঠকে ডাকিলেন, না কি সমালোচনায় ভীত হইয়া ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে নামিলেন, তাহা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু তাঁহার সিদ্ধান্তটি যে সমর্থনযোগ্য নহে, মুখ্যমন্ত্রীদের উপস্থিতিও যে তাহাকে গ্রহণযোগ্য করিতে পারে না, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। স্বাস্থ্য রাজ্যতালিকার বিষয়। জনস্বাস্থ্য লইয়া জেলার আধিকারিকদের সহিত বৈঠক ডাকিবার কাজটি রীতিবিরুদ্ধ, সৌজন্যহীনতারও নিদর্শন। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রশাসনের শীর্ষব্যক্তির পক্ষে তাহা একান্ত অশোভন। ইতিপূর্বে রাজীব গাঁধী তাঁহার প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে ‘পিএম টু ডিএম’ নীতির জন্য বিশেষ সমালোচিত হইয়াছিলেন। তবে তাহা ছিল উন্নয়নের প্রকল্পে বরাদ্দ কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ সরাসরি জেলাস্তরে পাঠাইবার সিদ্ধান্ত। এখন মোদী সরাসরি জেলাশাসকদের তলব করিয়াছেন। জাতীয় স্তরের প্রশাসনিক ব্যবস্থার অঙ্গ হইলেও, জেলাশাসকরা রাজ্য প্রশাসনের অধীনেই কাজ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁহাদের নিকট তথ্য চাহিলে, বা ‘পরামর্শ’ দান করিলে তাহাতে প্রশাসনিক কাজের স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হয়, বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষুব্ধ হইবেন, আশ্চর্য কী?
কেন্দ্রের ব্যাখ্যা, মোদী অতিশয় ঝুঁকিপ্রবণ জেলাগুলির আধিকারিকদের সহিত কথা বলিয়া পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিতে আগ্রহী। অতিমারি মোকাবিলার অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁহার সম্পূর্ণ গয়ংগচ্ছ ভঙ্গির সহিত এই অতিসক্রিয়তার বৈপরীত্য ভুলিয়া গেলেও এই ব্যাখ্যা ধোপে টিকিবে না। মুখ্যমন্ত্রীরাই কি প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ রূপে আক্রান্ত জেলাগুলির তথ্য জানাইতে পারিতেন না? ইহা সত্য যে, বিপর্যয় মোকাবিলার বিশেষ আইন কেন্দ্রীয় সরকারকে অনেক ক্ষমতা দিয়াছে। কিন্তু সেই ক্ষমতার ব্যবহারে দায়িত্বশীল হইবার দায় হইতে রেহাই দেয় নাই। অতিমারি রুখিতে আপৎকালীন উদ্যোগ প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই করিবেন, কিন্তু জেলা হইতে তথ্য সংগ্রহ করিবার নির্দিষ্ট প্রশাসনিক পথ থাকিতেও তাহাকে অবজ্ঞা করিবেন কেন?
এমন তো নহে যে, অতিমারি মোকাবিলার দায় হইতে রাজ্যগুলিকে অব্যাহতি দিয়া প্রধানমন্ত্রী সকল কর্তব্যভার আপন স্কন্ধে লইয়াছেন। টিকা হইতে অক্সিজেন, সকল চিকিৎসা উপকরণ জোগানের ভার মোদী রাজ্যগুলির উপরেই ছাড়িয়াছেন। এমনকি কোভিডের তৃতীয় ঢেউ রুখিতে কেন্দ্র যে কোনও পরিকল্পনাই প্রস্তুত করে নাই, তাহাও সম্প্রতি আদালতকে জানাইয়াছে। অর্থাৎ, রাজ্যগুলিকেই আপন সাধ্যমতো কোভিড মোকাবিলা করিতে হইবে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যগুলির সহিত অধিক সংযোগ রাখিয়া, পরস্পর সহযোগিতার মাধ্যমে কেন্দ্র ও রাজ্য কাজ করিবে, ইহাই প্রত্যাশিত। নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সাত বৎসর অতিবাহিত হইয়াছে। তাহার পূর্বে তিনি দীর্ঘ দিন একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করিয়াছেন। কেন্দ্র, রাজ্য ও জেলাস্তরের প্রশাসনের আদানপ্রদানের রীতি তাঁহার অজানা নহে। অথচ, সকলের সহিত সমন্বয়ের পথে না হাঁটিয়া তিনি সংঘাতের পথ ধরিয়াছেন। দেশের তীব্রতম সঙ্কটের পরিস্থিতির সম্মুখে দাঁড়াইয়া অকর্তব্যকে কর্তব্য বলিয়া মনে করিবার এই ঝোঁক বড়ই উদ্বেগজনক।