প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। —ফাইল চিত্র।
দেশের প্রধান বিচারপতিকে খোলা চিঠি লিখেছে কয়েকটি সুপরিচিত নাগরিক অধিকার সংগঠন। সংগঠনের সদস্যদের উদ্বেগ, কাশ্মীর থেকে ছত্তীসগঢ়, যেখানেই গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন নাগরিক, সেখানেই তাঁদের উপর নানা মাত্রায় হিংসা নেমে আসছে। প্রতিবাদীদের দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে মাওবাদী কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে। সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, জেলবন্দি হচ্ছেন গবেষক-অধ্যাপকরা। যাঁরা সর্বাধিক প্রান্তিক, সেই আদিবাসীরা বিশেষ ভাবে বিপন্ন। ওড়িশা, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র— যেখানেই তাঁরা খনির জন্য বাস্তুহারা হওয়ার প্রতিবাদ করে গণআন্দোলন করছেন, আইন অনুসারে গ্রামসভা আহ্বান করার এবং সভার সিদ্ধান্ত মানার দাবি করেছেন, সেখানেই দেখা যাচ্ছে পুলিশের ভুয়ো ‘এনকাউন্টার’-এর ঘটনা। নাগরিক সংগঠনগুলি বাক্স্বাধীনতা কিংবা মানবাধিকারের সুরক্ষা দাবি করে সমাবেশ করতে চাইলে তাদের অনুমোদন দিচ্ছে না পুলিশ। চিঠিতে উল্লিখিত এই কথাগুলি নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরে কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলিতে এমন ঘটনা পর পর ঘটে চলেছে। এই রাজ্যেই দেখা গিয়েছে, কোভিডের সময়ে একত্রে অনেকে জড়ো হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞার বিধি ব্যবহার করে পুলিশ কী ভাবে বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে যোগদানকারীদের গ্রেফতার করেছে। চিঠিটি মনে করাল, সারা দেশে এই ঘটনা কত নিরবচ্ছিন্ন ভাবে, কত অবাধে ঘটে চলেছে। নাগরিক প্রতিবাদের উপর পুলিশের নিপীড়নকে ‘স্বাভাবিক’ করে তোলার একটা ধারাবাহিক চেষ্টা দেখা যাচ্ছে, এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কোনও তফাত দেখা যাচ্ছে না। বিরোধী দলের সভা-সমাবেশের প্রতি শাসক যত অসহিষ্ণু, হিংস্র, নাগরিক সংগঠনের প্রতিও ততটাই। বিরো-স্বরের প্রতি যেমন বধির, তেমন নাগরিকের বক্তব্যের প্রতিও। নাগরিক সমাজ যেন সরকারের প্রতিপক্ষ, পুলিশ-প্রশাসনের ব্যবহারে এমনটাই মনে হতে বাধ্য।
গণতন্ত্রে নির্বাচিত সরকার নাগরিকের অধিকারের সুরক্ষায় দায়বদ্ধ। পুলিশ-প্রশাসন অধিকার লঙ্ঘনকেই যদি নিয়ম করে ফেলে, যদি ন্যায় চেয়ে মিছিল-সমাবেশ করলে প্রতিদানে মেলে প্রহার, মিথ্যা মামলা ও কারাবাস— তা হলে বিচারব্যবস্থার দরজায় এসে দাঁড়াতে বাধ্য নাগরিক সমাজ। গত কয়েক বছরে বিধানসভা, সংসদ যত অচল হয়েছে, প্রশাসনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নেতাদের মধ্যে মতবিনিময় যত কমেছে, ততই আন্দোলিত হয়েছে নাগরিক সমাজ। প্রশাসনের দুর্নীতি, অপদার্থতার অভিযোগে, অথবা সরকারের জনস্বার্থ-বিরোধী নানা সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে মানুষ দ্বারস্থ হয়েছেন আদালতের। আদালতের বিচার একটি ব্যয়বহুল, দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি, ফলে সমস্যার কতটুকু সমাধান তাতে হতে পারে? প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়কে ১৩৫ জন স্বাক্ষরকারীর খোলা চিঠিকে গণতন্ত্রের হাল নিয়ে নাগরিক উদ্বেগের প্রকাশ বলে ধরা যেতে পারে।
গত অক্টোবরে এ ভাবেই দেশের আঠারোটি সাংবাদিক সংগঠন তাঁকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল, গ্রেফতার করার কারণ দেখাতে যেমন পুলিশ দায়বদ্ধ, তেমনই সাংবাদিককে প্রশ্ন করতে চাইলেও তাঁদের যথাযথ কারণ দেখাতে হবে। অনির্দিষ্ট কোনও কারণ দেখিয়ে তাঁরা সাংবাদিকদের জেরা করতে পারেন না, ল্যাপটপ বা স্মার্টফোন বাজেয়াপ্ত করতে পারেন না। এই দাবিগুলির ন্যায্যতা নিয়ে সরকারের তরফে আলোচনার চেষ্টাই করা হয়নি। ভারতে গণতান্ত্রিক নাগরিকত্বের খোলসটুকু থাকছে কেবল, তৈরি করা হচ্ছে মতামতহীন, সমালোচনাহীন, মৌন মানুষের সমাজ। প্রতিবাদের ‘শাস্তি’ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, প্রতিবাদ বিক্ষোভে পরিণত হলে তা দমন করতে আরও বাড়ছে পুলিশের দমন-পীড়ন, শেষে ‘শান্তিরক্ষা’ করতে আধা-সামরিক বা সামরিক বাহিনীর ডাক পড়ছে। এই কি গণতন্ত্রের বিদায়ের পথ নয়?