Schools

পাঠশালা বন্ধ

স্কুলশিক্ষা ছাত্রছাত্রীদের জন্য যে স্রেফ প্রয়োজনীয়তা নয়, একটা অধিকার— এই দেশে এখন কোনও সরকারই আর তা মনে রাখে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৩ ০৬:১৭
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

বাহিনী শব্দটির অর্থ নদীও হয়, আবার সেনাদলও। পশ্চিমবঙ্গের স্কুলপড়ুয়ারা প্রথম অর্থটি জানে কি না সন্দেহ, তবে বর্তমান রাজ্য সরকারের জমানায় দ্বিতীয় অর্থটি যে তাদের বিলক্ষণ জানা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ পঞ্চায়েত ভোট এলেই ‘বাহিনী’ আসে এবং তাদের স্কুলবাড়িতে থাকে। ভোট মিটলেও তাদের স্কুল খোলে না, পড়াশোনা হয় না, কারণ তখনও স্কুলে বাহিনী থাকে। পঞ্চায়েত ভোট মিটে যাওয়ার পরেও স্পর্শকাতর জায়গাগুলিতে অশান্তির আশঙ্কায় আদালতের নির্দেশে অতিরিক্ত দশ দিন রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী রয়ে গিয়েছে; আদালত ও রাজ্য সরকার উভয়েই যদিও বলেছিল যে স্কুলে বাহিনী থাকবে না— অনেক জেলায় কিসান মান্ডি, কমিউনিটি হল, জেলা স্পোর্টস কমপ্লেক্স ইত্যাদি স্থানেও বাহিনীর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল— কিন্তু কোচবিহার থেকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর থেকে নদিয়া, জেলায় জেলায় দেখা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় বাহিনীর ঠিকানা হয়েছে সরকারি, সরকার-পোষিত ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলি। ফল: লেখাপড়া বন্ধ, ১ অগস্ট থেকে নির্ধারিত পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়নই প্রশ্নের মুখে, বহু স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, পরীক্ষা নেওয়া যাবে না কিংবা তা পিছোতে হবে।

Advertisement

স্কুলশিক্ষা ছাত্রছাত্রীদের জন্য যে স্রেফ প্রয়োজনীয়তা নয়, একটা অধিকার— এই দেশে এখন কোনও সরকারই আর তা মনে রাখে না। স্কুল যে প্রথমত এবং শেষ পর্যন্ত একটি পড়াশোনার জায়গা, তার কাজ পাঠ্যসূচি নিয়ে, প্রশাসনের কর্মসূচি নিয়ে নয়— এই সহজ কথাটা শুনলে আজকের নেতারা বিরক্ত হবেন, কে জানে, হয়তো বা রাষ্ট্রদ্রোহ বলে দাগিয়ে দেবেন। এই অবজ্ঞা আর অবহেলার মধ্যে আসলে আছে এই ঔদ্ধত্য যে, সরকারি, সরকার-পোষিত বা সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলিকে নিয়ে যা ইচ্ছা তা-ই করা যায়। চাইলেই গরমের ছুটি দিয়ে দেওয়া যায়, ইচ্ছামতো তা বাড়িয়ে দেওয়া যায়, স্কুল খুললেই পঞ্চায়েত ভোটের দামামা বাজিয়ে দিয়ে ফের তাদের ‘অধিগ্রহণ’ করা যায়, শিক্ষকদের ভোটের ‘ট্রেনিং’, ‘ডিউটি’ আর ‘কাউন্টিং’-এ জেরবার করে স্কুলগুলিকে দিনের পর দিন শিক্ষকহীন করে ফেলা যায়, এবং নবতম সংযোজন, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দিনের পর দিন আশ্রয় দিয়ে লেখাপড়াকেই নিরাশ্রয় করে তোলা যায়। নির্বাচনী হিংসার জেরে এ রাজ্যের স্কুলে স্কুলে ভাঙচুর, ঘর দেওয়াল আসবাব শৌচালয়ের দুর্দশা-সহ শিক্ষার সার্বিক ক্ষতির কথা নতুন করে না-ই বা বলা গেল, এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে আগেই তা লেখা হয়েছে (ক্ষতিপূরণ, ১৮-৭)।

ভোট মিটলেও স্পর্শকাতর এলাকাগুলিতে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর থেকে যাওয়ার প্রয়োজন থাকতেই পারে, সেটি একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু স্কুলগুলি সেই সিদ্ধান্তের বলি হতে পারে না। কেন্দ্রীয় বাহিনীর থাকার বন্দোবস্ত অন্যত্র হোক, সে জন্য ক্লাস বন্ধ করে স্কুল ছুটি থাকতে পারে না। কোনও স্কুলে জওয়ানদের দু’-তিনটি ঘর ফাঁকা করতে ‘অনুরোধ’ করে সেখানে ক্লাস চলছে— এই অবমাননা, এই মরমে মরে থাকা পশ্চিমবঙ্গের স্কুলগুলির প্রাপ্য নয়। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকরা বুঝছেন না, সরকারি স্কুল মানেই ‘সরকারের স্কুল’ নয়। বিদ্যালয় তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটি ‘পাবলিক গুড’, তা প্রশাসনের নয়, সমাজের সম্পদ। সরকারের কাজ তাকে সুষ্ঠু ভাবে চালানো— নিজের সম্পদ হিসাবে যথেচ্ছ ব্যবহার করা নয়। কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজন কে মেটাবে, কী ভাবে মেটাবে, কেন্দ্র সরকার ও রাজ্য সরকার মিলে তা ভেবে নিক, কিন্তু সমাজের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অংশের ক্ষতি করে সেই বন্দোবস্ত করা যাবে না। এই বক্তব্য আজ নাগরিক দাবির আকারে ধ্বনিত হওয়া উচিত ছিল। রাজনীতির উচিত ছিল এই নাগরিক দাবি তুলে ধরা। কিন্তু এ দেশের, এ রাজ্যের রাজনীতি বলতে আজ আর এই সব ‘দাবি’ গণ্য হয় না, দেখাই যাচ্ছে। অশিক্ষার কারবারিরা আর শিক্ষার মর্ম বুঝবেন কী উপায়ে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement