পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক হিংস্রতার মানচিত্রে নবতম সংযোজন সন্দেশখালি। —ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক হিংস্রতার মানচিত্রে নবতম সংযোজন সন্দেশখালি। শেখ শাহজাহান নামক দুষ্কৃতী তথা ‘রাজনৈতিক নেতা’র বাড়িতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর অভিযানকে ঘিরে ‘গ্রামবাসী’দের হিংসাত্মক আচরণ থেকে সেই সংবাদের সূচনা— এখন প্রতি দিনই সেই কুনাট্যে নতুনতর অধ্যায় যোগ হয়ে চলেছে। কিন্তু ব্যক্তি-নাম ও স্থান-নাম সরিয়ে রাখলে বলতেই হয় যে, সন্দেশখালিতে যা ঘটে চলেছে, তার মধ্যে নতুনত্ব তেমন নেই। পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকাই যেমন। পুলিশের নাকের ডগায় রাজনৈতিক প্রভাবশালী দুষ্কৃতীরা সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পারে, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ত্রাসের রাজত্ব চালাতে পারে, অথচ পুলিশের কিছুটি করার নেই কারণ তারা ওই প্রভাবশালীদের অঙ্গুলি নির্দেশেই উঠে-বসে— পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্রই তো এই ঘটনা ঘটে। একরের পর একর খাসজমি দখল করে এই প্রভাবশালীরা নিজেদের ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করলেও কোনও সরকারি দফতরের বিন্দুমাত্র সক্রিয়তা চোখে পড়ে না। এমনকি, কেন্দ্রীয় বাহিনীর অভিযানের পর থেকেই বারে বারে যে অভিযোগ উঠছে— পুলিশ সক্রিয় ভাবে প্রভাবশালীদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে— তাতেই বা নতুনত্ব কোথায়? সন্দেশখালিতে শিবু হাজরা-উত্তম সর্দারদের বিরুদ্ধে যাঁরা বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন, তাঁরা অনেকেই এখন পুলিশের ভয়ে ঘরছাড়া; শেখ শাহজাহান বা শিবু হাজরাকে কিন্তু পুলিশ এখনও ‘ধরতে পারেনি’। প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্টতা এ দেশের বহু পুরনো ব্যাধি, কিন্তু শিষ্টের দমন ও দুষ্টের পালনে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ ইদানীং যে কৃতিত্বের পরিচয় দিচ্ছে, তার তুলনা খুব বেশি নেই।
প্রশাসন যাকে ঢাকতে মরিয়া, তা হল শাসকপক্ষের দৌরাত্ম্য। পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্রই এখন শাসক দলের জার্সি গায়ে দিলে যে কোনও ধরনের অন্যায় করার ছাড়পত্র পাওয়া যায়। সন্দেশখালিতে এই রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা গায়ের জোরে স্থানীয় মানুষের জমি কেড়েছে, সরকারি সম্পত্তি দখল করেছে তো বটেই, আধিপত্য বজায় রাখার জন্য বেছে নিয়েছে জুলুমের যাবতীয় পদ্ধতিকেই। ঘটনা হল, কেবলমাত্র বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকরাই নন, তাদের এই তাণ্ডবের শিকার হয়েছেন শাসক দলেরই ভিন্ন শিবিরের কর্মী-সমর্থকরাও; রাজনীতির সঙ্গে নিতান্ত সংস্রবহীন সাধারণ মানুষও। বামফ্রন্টের শাসনকালের শেষ পর্বে এই রাজ্যের পরিস্থিতি সম্বন্ধে বারে বারেই উঠত মহাভারত-এর মুষলপর্বের কথা। বাম শাসনের মোট মেয়াদের এক-তৃতীয়াংশ অতিক্রম করেই বর্তমান শাসনকাল সেই মুষলপর্বে উপনীত হয়েছে। তার জন্য শুধুমাত্র শেখ শাহজাহান, অনুব্রত মণ্ডল বা আরাবুল ইসলামদের দায়ী করা চলে না— তাঁরা সেই সন্ত্রাসের মুখ ঠিকই, কিন্তু তাঁদের সস্নেহ মদত জুগিয়ে চলা শীর্ষনেতাদেরই এই দায়ের সিংহভাগ বহন করতে হবে। ‘ছোট ছেলেদের ছোট ভুল’-কে প্রশ্রয় দিলে রাজ্য শেষ অবধি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা তাঁরা জানতেন না, বিশ্বাস করা কঠিন।
পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের সক্রিয় প্রশ্রয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা যে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে আত্মঘাতী, এ কথাটি কি দলীয় নেতারা জানেন না? দেড় দশক আগে সিপিএম ঠিক এই ভুলটিই করেছিল, এবং সে দফায় তার সুবিধা পেয়েছিল তৃণমূল। এই দফায় তৃণমূলের এই তাণ্ডব মানুষের মনে যে ক্ষোভের সঞ্চার করছে, স্বভাবতই বিরোধীরা তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে প্রস্তুত। সন্দেশখালিতে যে ‘জনরোষ’ দেখা গিয়েছে, প্রকৃত প্রস্তাবে তা যে স্বতঃস্ফূর্ত নয়, তার পিছনে মূলত বিজেপির সাংগঠনিক ভূমিকা রয়েছে, এমন একটি সম্ভাবনা হাওয়ায় ভাসছে। শাসকের ভুলের সুবিধা বিরোধীপক্ষ নেবে, এটা গণতন্ত্রের ধর্ম। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে, তাতে বিরোধীপক্ষও পাল্টা সন্ত্রাসের পথেই হাঁটবে, তার প্রমাণ সন্দেশখালিতেই রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গকে রাজনৈতিক বারণাবত করে তোলার ঐতিহাসিক দায়টি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বহন করতেই হবে।