Sister Nivedita

আলোর পথযাত্রী

পরাধীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চার মূল্য বিরাট, বুঝেছিলেন নিবেদিতা। তাঁর মতো মানুষের কাছে জাতীয় গৌরব কোনও ফাঁপা রাজনীতির বুলি ছিল না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২২ ০৫:০১
Share:

ভগিনী নিবেদিতা। ফাইল চিত্র।

একশো পঞ্চাশ সংখ্যাটি বিশেষ হলে একশো পঞ্চান্নও তাই। বাস্তবিক, ভগিনী নিবেদিতার মতো মানুষের জন্য প্রতি জন্মবার্ষিকীই ‘বিশেষ’ হওয়া উচিত। কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা আক্ষরিক অর্থেই অলোকসামান্য, অনেক উৎসব পালন সত্ত্বেও যাঁর যথার্থ বিভা হয়তো সামান্য মানুষের কাছে শেষ পর্যন্ত পৌঁছতেও পারে না। আইরিশ কন্যা মার্গারেট নোবল ছিলেন তেমনই এক জন। স্বামী বিবেকানন্দের পাশে নিবেদিতার স্মরণও বাঙালির একটি প্রাত্যহিক কর্ম হয়ে উঠলে এই জাতির মঙ্গল হত। কেবল আধ্যাত্মিক পথে নয়, সমাজকর্মের পথটি ছাড়া যে সমাজের কল্যাণের উপায় নেই, স্বামী বিবেকানন্দ ও ভগিনী নিবেদিতা দুই জনেই নিজেদের জীবনের মধ্য দিয়ে সেই বার্তা দিয়ে গিয়েছেন। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রচার, শিক্ষা বিস্তার, নারীর শিক্ষা ও উন্নতিসাধন, এবং সংস্কারমুক্ত চিন্তার প্রসার: এই সব সূত্রে নিবেদিতার ভাবনা ও কাজকর্মের কথা কিছুটা জানা। তবে একশো বা দেড়শো-র মতো বিশেষ সংখ্যার জন্মবার্ষিকীর জন্য অপেক্ষা না করে, নিয়মিত ভিত্তিতে তার স্মরণ ও প্রচার জরুরি।

Advertisement

আরও একটি ভাবার বিষয় আছে। কেবল আধ্যাত্মিকতা ও সমাজকর্মও নয়। নিবেদিতা ভারতের বিজ্ঞানসাধনার গুরুত্বও বিশেষ রকম অনুধাবন করতেন। বাস্তবিক, আধ্যাত্মিক ও বিজ্ঞানসাধনা, এই দুই জীবনের মধ্যে যে দূরত্ব নেই, বরং সঙ্গতিই আছে, নিবেদিতা একাই এই বিরাট সত্যের স্মারক। ১৮৯৮ সালের ২৫ মার্চ স্বামী বিবেকানন্দ নিবেদিতাকে বেলুড় মঠে দীক্ষা দিয়েছিলেন, তার পরেই ভারতীয় বিজ্ঞানীজগতের সঙ্গেও নিবেদিতার ঘনিষ্ঠ আলাপের সুযোগ হয়। জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর মিত্রতার কথা বহুজ্ঞাত। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের সূত্রেই হয়তো নিবেদিতা স্পষ্ট দেখতে পান, বিজ্ঞানচর্চা ছাড়া ভারতীয় সমাজের আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ পাওয়া সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীর বিজ্ঞানসাধনার পথে সব সময়েই থাকে অনেক বাধা, পরাধীন দেশের অসচ্ছলতার পরিবেশে সেই বাধা হয়ে উঠতে পারে আরও কঠিন। অধ্যাপক-গবেষক জগদীশচন্দ্র বসুর উপর বিদেশি কর্তৃপক্ষ নির্দয়ের মতো চাপিয়ে দিতেন হাজারো কাজ, ইংরেজদের সমতুল বেতনও দিতেন না তাঁকে। তাঁর বিদেশ যাওয়ার পথেও তৈরি করা হয়েছিল বহু বাধা। এই সব দুঃসময়ে নিবেদিতাকেই পাশে পেয়েছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানীবর। রয়্যাল সোসাইটিতে পেপার পড়তে গিয়ে সে দেশে জগদীশচন্দ্র বসু অসুস্থ হয়ে পড়লে নিবেদিতাই তাঁকে তাঁর উইম্বলডনের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সেবাযত্নে সারিয়ে তোলেন। এই বাঙালি বিজ্ঞানী কত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে নিজের কাজ করছেন, দেখতেন নিবেদিতা, বিদেশি বিজ্ঞানজগৎ কত ভাবে অসহযোগিতা করছে, দেখতেন। নিবেদিতা বসুর এই সংগ্রামের নাম দিয়েছিলেন ‘বোস ওয়ার’। ১৯০২ সালে লন্ডন থেকে এক চিঠিতে জগদীশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, “আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না কী কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে আমায় যেতে হচ্ছে। গত মে মাসে রয়্যাল সোসাইটির জন্য তৈরি করা ‘প্লান্ট রেসপন্স’ নামে আমার লেখাটি শেষে ওয়ালার ও স্যান্ডারসন-এর চক্রান্তে বাধাপ্রাপ্ত হল। এবং আমার আবিষ্কার নভেম্বরে ওয়ালারের নিজের নামে জার্নালে প্রকাশিত হল। আমি কিছুই জানতাম না, ...হতাশ ও অবসন্ন লাগছে। এখন আমি ফিরে যেতে চাই, ভারতের মাটি ছুঁয়ে আবার জীবনের স্পৃহা ফিরে পেতে চাই।” এই বিষম কঠিন ‘যুদ্ধ’ জগদীশচন্দ্রের পক্ষে লড়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল নিবেদিতার জন্যও। স্নেহে-যত্নে নিবেদিতা যথাসম্ভব আগলে রেখেছিলেন তাঁকে। জগদীশচন্দ্র লিখে গিয়েছেন, “হতাশ ও অবসন্ন বোধ করিলে আমি নিবেদিতার নিকট আশ্রয় লইতাম।”

পরাধীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চার মূল্য বিরাট, বুঝেছিলেন নিবেদিতা। তাঁর মতো মানুষের কাছে জাতীয় গৌরব কোনও ফাঁপা রাজনীতির বুলি ছিল না। ঐতিহ্যের আধুনিকতায় জাতীয় বোধকে জারিয়ে নিতেন তাঁরা। তাই তাঁর বিরাট হৃদয়ে কেবল বিজ্ঞানীর জন্য আশ্রয় ছিল না, ছিল শিল্পকলাসাধকদের জন্যও। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু দুই শিল্পীই তাঁর সান্নিধ্যে এসে উৎসাহ পেতেন। অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: “তাঁর কাছে গিয়ে কথা বললে মনে বল পাওয়া যেত।” বোস ইনস্টিটিউটে নিবেদিতার মর্মরমূর্তিটি নন্দলাল বসুর আঁকা ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ ছবি অনুসারেই নির্মিত। সে মূর্তি যেন আজও একাকী আলোকবর্তিকার মতো আগ্রহী কর্মসাধকের পথপ্রত্যাশী।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement