২৮ মে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে ছাড়াই অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সংসদ উদ্বোধন। ফাইল চিত্র।
লক্ষ করে দেখলে বোঝা যায়, স্বাধীনতার পরবর্তী পাঁচ বছর (১৯৪৭ থেকে ১৯৫২, প্রথম জাতীয় নির্বাচনের আগে পর্যন্ত) ভারতীয় রাষ্ট্রের চরিত্র যে ভাবে ‘তৈরি’ হয়েছিল, তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে একমাত্র গত চার-পাঁচটি বছরের ঘটনা বলিই। এত মৌলিক ‘নির্মাণ’ কিংবা ‘বিনির্মাণ’ গত সাত দশকে দেখা যায়নি বললে অত্যুক্তি হয় না। কিছু দিন আগে একটি সাক্ষাৎকারে রামচন্দ্র গুহ এমনই এক পর্যবেক্ষণ করেছেন। অলক্ষ্যে যেন পুনর্লিখিত হচ্ছে ভারতীয় ‘সংবিধান’, গণতন্ত্রী প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের চেহারা পাল্টাচ্ছে গভীর ও ব্যাপ্ত আকারে। নতুবা নবনির্মিত সংসদ ভবনের উদ্বোধনকে ঘিরে এই কুনাট্য হত না। এমন একটি ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান ব্যক্তি রাষ্ট্রপতিকে ছাড়া সংঘটিত করার কথা ভাবাই যেত না। অথচ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার অবলীলায় এমন পদক্ষেপ করতে পারল। ২৮ মে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে ছাড়াই অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সংসদ উদ্বোধন, বাদ পড়েছেন পূর্বতন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দও। বর্তমান ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠানের কেন্দ্রে থাকবেন— অবশ্যই, প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। এই ভাবেই নজরের আড়াল দিয়ে পাল্টে চলেছে রাষ্ট্রের আকার ও প্রকার।
অথচ, রামনাথ কোবিন্দ বা দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি পদে বরণ করার সময়ে কিন্তু মোদী সরকারের ভূমিকা ছিল— এক কথায়— মহোৎসাহী। অনেক বড় কথা, অনেক আবেগসিঞ্চিত উচ্চারণ তখন শ্রুত হয়েছে, স্বাভাবিক ভাবেই, কেননা প্রথম জন ছিলেন দলিত, দ্বিতীয় জন জনজাতি গোত্রভুক্ত নারী। রাষ্ট্রের কাছে এ নিশ্চয়ই এক গৌরবের বিষয়। কিন্তু তত ক্ষণই সেই গৌরব, যত ক্ষণ পদটি তার নিজের প্রকৃত গৌরবে উদ্ভাসিত হতে পারে। ভোটের প্রয়োজনে তাঁদের পরিচয়কে এই ভাবে ‘ব্যবহার’ করা, এবং সর্বোচ্চ স্তরের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তাঁদের আমন্ত্রণ না জানানোর মধ্যে যা আছে, তা এক কথায়, নিকৃষ্ট স্তরের রাজনৈতিক সুযোগসন্ধান। এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মর্যাদাহনন। রাষ্ট্রপতি নামের প্রতিষ্ঠানটির মাহাত্ম্য তা হলে গিয়ে ঠেকেছে কেবল ভোটের অস্ত্র হিসাবে তাকে শানিয়ে তুলতে। এই নবসংজ্ঞায়িত ভারতের রাষ্ট্রপতি আর রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি নন, সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসক দলের ‘অস্ত্র’মাত্রে অবনমিত। রাহুল গান্ধী ও অন্য কংগ্রেস নেতারা-সহ অনেক বিরোধীই রাষ্ট্রপতি পদ নিয়ে এই প্রতীক-রাজনীতি এখনই থামানোর দাবি তুলেছেন। কেউ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী সংসদের ‘মালিক’ নন যে তিনি এমন কাজ করতে পারেন। সেই গুরুত্ব একমাত্র প্রাপ্য রাষ্ট্রপতিরই, যিনি রাষ্ট্রের শীর্ষস্থানটির অধিকারী।
তবে কি না, রাষ্ট্রপতির অসম্মানই এই উদ্বোধন অনুষ্ঠানের একমাত্র কুনাট্য নয়। ২৮ মে অনুষ্ঠানের প্রহর ধার্য হয়েছে সে-দিন বিনায়ক দামোদর সাভারকরের জন্মদিন বলে। আক্ষরিক অর্থে অ-সাধারণ এই সিদ্ধান্তটিও ভারতীয় রাষ্ট্রের চরিত্র পরিবর্তনের অমোঘ প্রতীক। স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল পুরোধা নেতাকে বাদ দিয়ে, রাষ্ট্রীয় সংবিধানের বরেণ্য রচয়িতাদের বাদ দিয়ে, সাভারকরকে এ ভাবে তাঁর অপ্রাপ্য গুরুত্বে মণ্ডিত করা— তা সমগ্র রাষ্ট্রের পক্ষেই অবমাননাকর। সাভারকর সাম্রাজ্যবাদী শাসকের জেল থেকে দস্তখত দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন কি না, সে নিয়ে যাঁরা বিতর্ক তুলতে চান, তুলতে পারেন, তথ্যপ্রমাণের তোয়াক্কা না করে। কিন্তু বিতর্কোর্ধ্ব ভাবে প্রকৃত ঘটনা হল, এ দেশের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনে এই হিন্দুত্ব-তত্ত্ব প্রণয়নকারীর আদৌ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল না। সুতরাং, বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই সুবিপুল ব্যয়সিদ্ধ নতুন সংসদের উদ্বোধন অনুষ্ঠান আসলে কতটাই ‘ঐতিহাসিক’ হতে চলেছে। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারতীয় ‘অতীত’, ‘বর্তমান’— এবং সম্ভবত ‘ভবিষ্যৎ’-এরও— পরিবর্তন-যজ্ঞের অভ্রান্ত প্রতীক এই নব-ভবন।