প্রতীকী ছবি।
এমন পরিসংখ্যান প্রতি দিনই মিলিতেছে, যাহা ভারতীয় অর্থব্যবস্থা সম্বন্ধে উদ্বেগ গভীরতর করিবে। জানা গেল, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় এখন শিল্পসংক্রান্ত ঋণকে পিছনে ঠেলিয়া সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আসনটি দখল করিয়াছে ব্যক্তিগত ঋণ। তাহার পর দিনই সংবাদ মিলিল যে, পরিভাষায় যাহাকে কোর সেক্টর বলা হয়, সেই উৎপাদন ক্ষেত্রটিতে ফেব্রুয়ারি মাসে অতি তাৎপর্যপূর্ণ সঙ্কোচন হইয়াছে। গত ফেব্রুয়ারির তুলনায় সার্বিক ভাবে সঙ্কোচনের পরিমাণ ৪.৬ শতাংশ। কয়লা, ইস্পাত, বিদ্যুৎ, পেট্রোপণ্য— সবেরই উৎপাদন কমিয়াছে। অতিমারি শুরু হইবার পর হইতে উৎপাদন প্রতি মাসেই কমিতেছিল। গত বৎসরের শেষে ঘুরিয়া দাঁড়াইবার একটি ইঙ্গিতমাত্র দিয়া উৎপাদনের সূচক ফের নিম্নমুখী হয়।
পরিস্থিতিটি অতি উদ্বেগজনক। শিল্পক্ষেত্রে ঋণের চাহিদা কমিতেছে, এবং উৎপাদনের সূচকও নিম্নমুখী— দুইটি বিষয়কে মিলাইলে যাহা স্পষ্ট হয়, তাহা হইল, ভারতের বাজারে এই মন্দা সহজে কাটিবার নহে। মন্ত্রী আমলারা বুঝাইয়া বলিবেন যে, এই পরিস্থিতি অতিমারির কারণেই হইয়াছে— কিন্তু, তাহা যে নহে, পরিসংখ্যানই সেই কথা বলিয়া দিবে। ভারতে চাহিদার সমস্যা চলিতেছিল বেশ কয়েক বৎসর যাবৎ। নোট বাতিল এবং জিএসটি-র জোড়া ধাক্কা হইতে অর্থব্যবস্থা ঘুরিয়া দাঁড়াইতে পারে নাই। সেই কারণেই অতিমারির ধাক্কাটিও ভারতের উপর প্রবলতর হইয়াছে— অন্যান্য বৃহৎ অর্থব্যবস্থাগুলির তুলনায় ভারতে জাতীয় আয়ের সঙ্কোচনের পরিমাণ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেশি। এবং, অর্থব্যবস্থার চাকা বহুলাংশে ঘুরিতে আরম্ভ করিবার পরও, ফেব্রুয়ারি মাসে কোর সেক্টরের এই সঙ্কোচন বলিতেছে, মূল সমস্যাটি থাকিয়াই গিয়াছে। বাজারে সার্বিক ভাবে চাহিদা ফিরিলে কোর সেক্টরের চাহিদাও বাড়ে— ফলে, বাজারে চাহিদা তৈরি হইলে এই ক্ষেত্রটিকে ধুঁকিতে হইত না।
এক্ষণে প্রশ্ন, অর্থব্যবস্থায় প্রাণসঞ্চার করিতে হইলে কী করণীয়? একটি কথা স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে— গত এক বৎসরে কেন্দ্রীয় সরকার সহজলভ্য ব্যাঙ্কঋণ ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থব্যবস্থাকে চাঙ্গা করিবার যে চেষ্টাটি করিতেছিল, তাহা যথেষ্ট ফলপ্রসূ হয় নাই। ঋণ যতই সহজলভ্য হউক না কেন, বাজারে চাহিদা না থাকিলে কেহ ঋণ লইয়া ব্যবসায় লগ্নি করেন না। ফলে, মূল কর্তব্য ছিল বাজারে চাহিদা ফিরাইয়া আনা। সেই পথে বৃহত্তম বাধার নাম বেকারত্ব। ভারতের যুবসম্প্রদায়ের প্রতি চার জনের মধ্যে এক জন বর্তমানে বেকার— কৃষিক্ষেত্রে প্রচ্ছন্ন বেকারত্বের পরিমাণটি হিসাবে লইলে এই অনুপাত আরও বাড়িবে। ভারতে আর্থিক সংস্কারের সূচনার পর কখনও বেকারত্ব এমন তীব্র হয় নাই। এই সমস্যা সমাধানের একটি পথ হইতে পারিত গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনায় বর্ধিত বরাদ্দ। কিন্তু, এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী সেই সম্ভাবনাকে মারিয়া রাখিয়াছেন। এই মুহূর্তে যে কোনও ভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করাই প্রথম কাজ। বাজারে চাহিদা না ফিরিলে অর্থব্যবস্থার সমস্যা গভীরতর হইবে, এবং তাহার মেয়াদও বাড়িতেই থাকিবে। কিন্তু, তাহারও আগে দেশের শাসকদের স্বীকার করিতে হইবে যে গভীর সমস্যা আছে— অতিমারির ঘাড়ে দোষ চাপাইয়া নিজেদের আড়াল করা চলিবে না। রোগ স্বীকার করিলে তবেই চিকিৎসা সম্ভব।