খুব বেশি দিন আগের কথা নহে। বঙ্গে পালাবদলের অব্যবহিত পূর্বের সেই সময়টায় রাজনীতিতে কুকথার বান ডাকিয়াছিল। সমাজমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া তখনও এতটা বলবান হয় নাই। জনমতের প্রতিফলন এবং রাজনীতির ভাষ্য রচনায় তাহার ভূমিকা তখনও এতখানি নির্ণায়ক হইয়া উঠে নাই। স্মার্টফোনের আবির্ভাব হইতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব আছে। কুকথাকে কুকথা বলিয়া চিহ্নিত করা তখনও আজকের তুলনায় কিছুটা সহজতর। কুকথার আর্থ-সামাজিক তাৎপর্য এবং সাংস্কৃতিক পটভূমিকা বিষয়ক সন্দর্ভ রচনা করিবার লোক তখনও কম ছিল। কালপ্রবাহ বহিতেছে— সে পটও পরিবর্তিত হইয়াছে। ডিজিটাল গণতন্ত্র তাহার একটা কারণ অবশ্যই। তৎসহ কুকথার প্রতি বঙ্গসমাজের দৃষ্টিভঙ্গির একটা পরিবর্তনও তলে তলে সম্পন্ন হইয়াছে, অধিকতর চিন্তার বিষয় সেইখানেই। অশিষ্টতা, অভব্যতাকে তাত্ত্বিক মোড়কে উদ্যাপন করিলে তাৎক্ষণিক হাততালি হয়তো জোটে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ভাষা, সংস্কৃতি ও জনরুচির ক্ষতি হয়। এই সহজ সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করিতে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট।
বারো-পনেরো বৎসর পূর্বে সংবাদ চ্যানেলের সৌজন্যে যখন রাজনীতিবিদদের কুকথার সরাসরি সম্প্রচার ঘটিতে শুরু করে, আলোড়ন-শিহরন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। এখন আলোড়ন আছে, শিহরন নাই। কারণ এই কয় বৎসরে জনপরিসরে কুকথার তাণ্ডব বঙ্গজীবনের অঙ্গ হইয়াছে। ব্যতিক্রম থেকে দৈনন্দিন হইয়াছে। রাজনীতির মঞ্চে নব নব কুবাক্যবাগীশ আবির্ভূত। সোশ্যাল মিডিয়াপ্রাচীরে অবাধ গালি উদ্গিরণ। টেলিভিশনে সান্ধ্যকালীন কুবাক্যসভা। পেশাদার ট্রোলবাহিনী। হাতে হাতে ফোন, ফোনে ফোনে ভাইরাল ভিডিয়ো-স্ক্রিনশট। বিপ-মুক্ত ওটিটি। কদর্যতার অক্লান্ত আদানপ্রদানে আমরা এমনই অভ্যস্ত মায় আত্মপ্রসন্ন যে, অপভাষা ক্রমশই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিনোদনীমূল্য অর্জন করিয়াছে। চিত্রপরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ একবার বলিয়াছিলেন, গ্যাংস অব ওয়াসেপুর নির্মাণের সময়ে ছবিটির স্থান-কাল-পাত্রের বৈশিষ্ট্য নিরূপণের স্বার্থে তিনি সংলাপে যে অশিষ্ট ভাষা ব্যবহার করিয়াছিলেন, দর্শক কেন তাহাতে সোল্লাস আমোদ পাইল, তাহা ভাবিয়া দেখা দরকার। বেশি দূর ভাবিতে হইবে না, কষ্ট করিয়া রাস্তায় বাহির হইবারও প্রয়োজন নাই। মুষ্টিবদ্ধ ফোনটিতে নেট সংযোগ চালু করিলেই ডিজিটাল রকে-উঠানে, টিভির পর্দায় অশিষ্টতার ফোয়ারা অনর্গল। সাহিত্যে-চলচ্চিত্রে-সঙ্গীতে অপভাষার ব্যবহার তাই আর ‘শক’ দেয় না, পাঠক-দর্শক বরং দ্রুত একাত্মবোধে আপ্লুত হইয়া পড়েন। অতঃপর সাহিত্য-সংস্কৃতি-সেলেব্রিটি-জননেতা মারফত অপভাষার ব্যবহার এবং তাহাদের ত্বরিত ভাইরালীকরণে পৌনঃপুনিক এক-একটি ‘ইভেন্ট’-এর জন্ম। প্রথম বারে যাহা ন্যক্কারজনক মনে হইয়াছিল, তৃতীয় অঙ্কে পৌঁছিয়া তাহা ফিকা লাগে। কারণ অশ্রাব্যতা নিত্যই পূর্বের রেকর্ড চূর্ণ করিতেছে। একদার স্খলন অবলীলায় অধুনার চলনে পরিণত হইতেছে।
ইতিহাস বলিতেছে, উপর্যুপরি ব্যবহারে যে কোনও জিনিসই ভোঁতা হয়। অপভাষাও হয়তো তাহার ব্যতিক্রম নহে। কিন্তু তাহাকে আশা ভাবিয়া বুক বাঁধিবার অর্থ নাই। বরং বিপদের বার্তাটি দেখিয়া বিপন্ন বোধ করিলে ভাল। অপভাষা যে হেতু ভাষারই একটি অঙ্গ, এবং ভাষা যে হেতু সামাজিক অস্তিত্বের সূচক— অপভাষার এই বিপুলতা ও ব্যাপকতা আসলে ভাষা এবং সমাজের সামগ্রিক দৈন্যকেই সূচিত করে। শ্রেণি, বর্ণ, লিঙ্গ, স্থানিকতার চিহ্নবাহী অপভাষার শক্তি তাহার অন্তর্ঘাতী চরিত্রে। তাহা যত্রতত্র অনিয়ন্ত্রিত ভাবে ব্যবহার্য নহে। অপভাষা অহরহ তাহার লক্ষ্মণরেখা লঙ্ঘন করিলে তাহারও শক্তিক্ষয়, মূল ভাষারও অবনমন। কোনও পবিত্র ক্রোধের দোহাই পাড়িয়াই তাহা সমর্থন করা যায় না। করিলে ক্রোধের পবিত্রতা ঘিরিয়াই প্রশ্ন উঠিবে। বিদ্বেষের কারবারিরাই জয়যুক্ত হইবে। লুটের বদলা লুট, খুনের বদলা খুন, ধর্ষণের বদলা ধর্ষণের পথ যদি নিন্দার্হ হয়, তবে কুকথার বদলা কুকথাও সমান ভাবে নিন্দার্হ ও পরিত্যাজ্য। প্রতিবাদীর ভাষা যেন প্রতিবাদের ভাষার ক্ষতিসাধন না করে, সেই বিষয়ে সচেতন হইবার বিশেষ প্রয়োজন আছে। এবং যাঁহাদের সমাজের শিরোভাগে থাকিবার খ্যাতি জন্মিয়াছে, তাঁহাদের সচেতন হইবার কেবল প্রয়োজন নয়, দায়িত্বও আছে। ভাষা লইয়া তাঁহাদের কারবার যখন, ভাবিয়া দেখিতে পারেন, অপভাষাটুকু কষ্ট করিয়া বাদ দিয়া নিজের মনোভাব জ্ঞাপন করিবার কোনও পথ ভাষাপৃথিবীতে অনুপস্থিত কি না!
যৎকিঞ্চিৎ
মূর্তির প্রয়োজন কী? বছরে দু’দিন নেতারা মালা-টালা দিয়ে কোমল, করুণ বা রুদ্র রসের ভাষণ সেরে পরবর্তী মূর্তির খোঁজে চলে যাবেন, তাই তো? বাকি ৩৬৩ দিন মূর্তির গলায় বাসি মালা, মুখের সামনে বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং, এবং মাথায় পাখির পুরীষ। এই জঘন্য পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের মন্ত্র নিয়ে শেষ পর্যন্ত যখন হলোগ্রাম মূর্তি স্থাপিত হল, তখন জন্মদিন মেটার পর সেই মূর্তির অন্তর্ধান নিয়ে হইচই করছেন কারা? মুখের সামনে অমৃতের ভাণ্ড ধরলেও যাঁরা বলবেন, কই, অচ্ছে দিন এল না তো?