বাজেটের পূর্বাহ্ণে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে প্রশ্ন উত্থাপন করা হইয়াছিল— প্রতি বাজেটেই যে প্রতিশ্রুতির বন্যা বহিয়া যায়, শেষ অবধি সেই প্রতিশ্রুতিগুলির কী গতি হয় (‘ভ্রান্ত অতীত’, ৩১-১)। সেই আলোচনায় যে তিনটি ক্ষেত্রকে বাছিয়া লওয়া হইয়াছিল— যথাক্রমে বিলগ্নিকরণ, মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনা, এবং পরিকাঠামো খাতে লগ্নি— এই বাজেটে উল্লেখ বা অনুল্লেখে এই তিনটি ক্ষেত্রই বিশেষ ভাবে দৃশ্যমান। ২০২১-২২ অর্থবর্ষের বাজেটে বিলগ্নিকরণের লক্ষ্যমাত্রা স্থির হইয়াছিল ১,৭৮,০০০ কোটি টাকা। প্রকৃত বিলগ্নিকরণের পরিমাণ, পূর্ববর্তী অর্থবর্ষগুলির ধারা অনুসরণ করিয়াই, লক্ষ্যসীমার ধারেকাছেও পৌঁছায় নাই। সম্ভবত সেই কারণেই এই বাজেটে বিলগ্নিকরণের লক্ষ্যমাত্রা ছাঁটিয়া গত বাজেটের এক-তৃতীয়াংশে লইয়া আসিয়াছেন অর্থমন্ত্রী। এক অর্থে, কাজটি ভালই করিয়াছেন। প্রতি বৎসর সরকারকে বিলগ্নিকরণের ক্ষেত্রে লক্ষ্যভ্রষ্ট হইতে দেখিলে বাজারের মনে যে সংশয়গুলি তৈরি হয়, তাহা সরকারের পক্ষে সুসংবাদ হইতে পারে না। রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের কতখানি বিক্রয়ের যোগ্য, এই প্রাথমিক ধারণাটুকু সরকারের আছে, এই কথাটি প্রমাণ করা জরুরি। কিন্তু, প্রশ্ন হইল, বিলগ্নিকরণ প্রক্রিয়া যদি গতিশীল না হইতে পারে, তাহা হইলে পরিকাঠামো খাতে নূতন লগ্নির অর্থসংস্থান হইবে কোন পথে? এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী ন্যাশনাল মনিটাইজ়েশন পাইপলাইন-এর নামমাত্র আছে। তাহাতে কাজ হইতেছে অথবা হইবে কি না, জানা প্রয়োজন।
এই প্রশ্নটি বর্তমান বাজেটের পর আরও গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সিকি শতাব্দীর মেয়াদে যে উন্নয়ন পরিকল্পনা শুনাইয়াছেন, তাহার সফল রূপায়ণ যদি করিতে হয়, তবে বিস্তর অর্থের প্রয়োজন। তাহার সংস্থান কী উপায়ে হইবে, এই বাজেটে তাহার স্পষ্ট দিগ্নির্দেশ নাই। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করিতে হয়, জিডিপি-র অনুপাতে কর আদায়ের পরিমাণ ভারতে এখনও কম। অর্থের জোগানের পথগুলি খুলিবার কথা ভাবিতে হইবে। তবে, পরিকাঠামোয় আদৌ বিনিয়োগ প্রয়োজন হইবে, না কি বাজেট-ঘোষণাগুলি শুধু কথার কথামাত্র, সেই প্রশ্নের অবকাশ থাকিতেছে। এই বাজেটে সড়ক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় লগ্নির পরিমাণ বাড়িয়াছে প্রায় সত্তর শতাংশ; রেলের বাজেটও বাড়িয়াছে ২৭.৫ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী গতিশক্তি যোজনায় সামগ্রিক লজিস্টিক্স ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিবার উপর জোর দিয়াছেন অর্থমন্ত্রী। তাহার বাস্তবায়ন হইলে সত্যই অর্থব্যবস্থায় নূতন গতির সঞ্চার হইতে পারে। কিন্তু, পরিকাঠামো গড়িয়া তুলিলেই উৎপাদন বাড়িবে, এই বিশ্বাসটিকে স্বতঃসিদ্ধ ধরিয়া লইবার বিপদ আছে, অর্থমন্ত্রীকে তাহাও স্মরণ করাইয়া দেওয়া প্রয়োজন।
বাজেট বক্তৃতায় অনুপস্থিতির কারণে বিশেষ ভাবে দৃশ্যমান হইয়াছে মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনা, এবং জাতীয় খাদ্য নিশ্চয়তা আইনের অনর্গত গণবণ্টন ব্যবস্থা। প্রথমটির ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ ২০২১-২২ অর্থবর্ষের প্রকৃত বরাদ্দ অপেক্ষা ২৫,০০০ কোটি টাকা কমিয়াছে; দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে বরাদ্দের পরিমাণ গত বাজেট বরাদ্দের তুলনাতেই কম। অনুমান করা চলে, অর্থশাস্ত্রীরা এই প্রকল্প দুইটিকে যতখানি গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া বোধ করেন, কেন্দ্রীয় সরকার তাহা করে না। কিন্তু, এই প্রকল্পগুলি অর্থাভাবে পঙ্গু হইয়া গেলে কোন উপায়ে দরিদ্র মানুষের পাতে অন্নের সংস্থান হইবে, কী ভাবেই বা তাঁহাদের আয়বৃদ্ধির ব্যবস্থা হইবে, অর্থমন্ত্রী জানান নাই। ট্রিকল ডাউন অর্থনীতির তত্ত্বের উপর সব দায়ভার ছাড়িয়া দিলে যে মুশকিল, এই কথাটি তাঁহারা স্বীকার করেন কি না, এই বাজেটে স্পষ্ট হইল না। সম্ভবত, সব সহ্য করিয়াও আগামী পঁচিশ বৎসর যাঁহারা বাঁচিয়া থাকিবেন, তাঁহারাই অমৃতের প্রকৃত হকদার।