দেশের নানা প্রান্ত যখন উৎসবে মাতিল, গুলির লড়াই বিদীর্ণ করিল জম্মু ও কাশ্মীরকে। গত সোমবার উপত্যকার এক গভীর জঙ্গলে জঙ্গিদের গুলিতে নিহত হইলেন পাঁচ সেনা। ২০০৪ সালে চার সেনার হত্যার পর ইহাপেক্ষা ভয়াবহ ঘটনা আর ঘটে নাই। এবং, সোমবারের পরে সেনা-তল্লাশিতে জঙ্গিরা ধরা না পড়িলেও বৃহস্পতিবার রাতে আরও দুই সেনাকর্মীর নিহত হইবার সংবাদ মিলিয়াছে। অক্টোবর মাসের গোড়ায় একের পর এক সাধারণ নাগরিকের হত্যা যে আতঙ্ক সূচিত করিয়াছিল, সাত সেনার মৃত্যুতে তাহার মাত্রাটি অনেকখানি বাড়িয়া গেল। এই পর্বে যে নাগরিকেরা নিহত হইয়াছেন, তাঁহারা হয় কাশ্মীরের আদি বাসিন্দা নহেন, নয়তো ধর্মপরিচয়ে সংখ্যালঘু। অতএব, অতি নীরবে এক নিষ্ক্রমণ পর্ব শুরু হইয়াছে। ইহার উদ্বেগ মানিয়াও বলিতে হয় যে, সেনাদলের মৃত্যুতে অধিক চিন্তার কারণ আছে। নিরীহ-নিরস্ত্র নাগরিক চির দিনই জঙ্গিদের সহজ লক্ষ্য, কিন্তু যাহারা দিনের পর দিন গুলির লড়াই চালাইয়া যাইতে পারে, তাহাদের ক্ষমতা ও মদতদাতা সম্পর্কে রাষ্ট্রের অনেকখানি সময় ব্যয় করা প্রয়োজন। অদ্যাবধি জানা গিয়াছে, ইহারা নিয়ন্ত্রণরেখা পার করিয়া ভারতে প্রবেশ করিয়াছে। কিন্তু এইটুকু তথ্যই কি যথেষ্ট? জালের পরিপূর্ণ বিস্তারটি চিহ্নিত না করিতে পারিলে হিংসা ঠেকানো কি সম্ভব? ভুলিলে চলিবে না, কাশ্মীরে সেনার উপর এমন সশস্ত্র হামলা অভূতপূর্ব না হইলেও বিরল।
প্রেক্ষাপটটি স্বভাবতই বহুধাবিস্তৃত। ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার এবং কেন্দ্রীয় শাসনের অতিরেক প্রশাসনের প্রতি কাশ্মীরিদের বীতরাগ বাড়াইয়াছে। মাসের পর মাস লকডাউন এবং ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকিবার ফলে সরকারের প্রতি সেই ক্ষোভ ভারতবিরোধী মানসিকতায় পরিণত হইয়াছে। যুবসমাজের চরম মনোভাবে রাজনীতির মধ্যপন্থীদের স্বাভাবিক বিলয় ঘটিয়াছে। একপ্রস্তরীয় কাশ্মীরি রাজনীতিতে উগ্রপন্থাই প্রায় শেষ সত্য হইয়া উঠিতেছে। সকল বিপদের জবাব অবশ্য ভারতীয় প্রশাসনের ভ্রান্ত বা অন্যায্য নীতিতে মিলিবে না। আফগানিস্তানে জঙ্গিদল তালিবানের ক্ষমতা দখল আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাবনিকাশ পাল্টাইয়াছে। উগ্রপন্থী আমিরশাহির সমর্থনে কাশ্মীরি জনমতও অজ্ঞাত নহে। উপত্যকার উন্মাদনা মাপিতে ভুল করে নাই পাকিস্তানও। সংবাদে প্রকাশ, সীমান্তে সেনা জড়ো করিতেছে ইসলামাবাদ। এই পরিবর্তিত ভারসাম্যের ফলাফল কী হইবে, তাহা এখনও অনুমেয় না হইলেও, ভারত সরকারের চক্ষু মুদিয়া থাকিবার অবস্থানটি নিশ্চিত ভাবেই দূরদৃষ্টির অভাব প্রকট করিয়াছে। সাম্প্রতিক হামলাগুলিই প্রমাণ করিতেছে, অস্ত্রভান্ডার কতখানি বৃদ্ধি পাইয়াছে, এবং জঙ্গিগোষ্ঠীর সীমাবদ্ধ গণ্ডি হইতে সমাজের অন্যত্রও ছড়াইয়া গিয়াছে। নতুবা দিনদুপুরে নাগরিক হত্যা বা সপ্তাহব্যাপী সেনার সহিত লড়াই এতখানি সহজে চলিতে পারিত না। অন্ধ হইলেও প্রলয় বন্ধ থাকিবে না, অতএব সেনা-জঙ্গি গুলির লড়াইয়ের মধ্যেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলিয়া চলা কঠিন। দেশের অপর প্রান্তের পর্যটকদের আহ্বান জানাইবার সিদ্ধান্তসমূহের পশ্চাতে প্রকৃত কথাটি হইল— কাশ্মীরের অবস্থা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এবং এই কথাটি সমগ্র দেশেই সচেতন নাগরিকের জানা প্রয়োজন।