হাওড়ার বহুতল আবাসনের ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে বৃদ্ধার পচন ধরা দেহ উদ্ধার হল, মৃত্যুর আনুমানিক তিন দিন পর। বলে দিতে হবে না যে, এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে মানুষটির একাকী ও নিঃসঙ্গ অবস্থায়, আপনজনের নৈকট্য ও শুশ্রূষা থেকে দূরে— নয়তো দুঃসংবাদটি জানা যেত আগেই, মৃতদেহের কটু গন্ধ তার বার্তাবহ হত না। একই দিনে নরেন্দ্রপুরের বাড়ি থেকে উদ্ধার হল আরও এক প্রৌঢ়ার মৃতদেহ। এই ঘটনাটি আরও মর্মান্তিক: মশা তাড়ানোর ধূপ থেকে রাতে বিছানায় আগুন লেগে যায়, ঘুমের মধ্যেই দগ্ধ হয়ে মৃত্যু— মহিলা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ায় চিৎকার করতে বা কাউকে ডাকতে পর্যন্ত পারেননি। রাতভর জ্বলতে থাকা ধিকিধিকি আগুনের ধোঁয়া দেখে সকালে প্রতিবেশী সবাইকে খবর দেন, তাতে শেষরক্ষা হয়নি।
বার্ধক্য অনিবার্য। ভারতীয় তথা বাঙালি সমাজে বৃদ্ধ মানুষের একা থাকার বাধ্যবাধকতাও ইদানীং ক্রমবর্ধমান। নরেন্দ্রপুর বা হাওড়ার ঘটনা বিক্ষিপ্ত বা ব্যতিক্রমী নয়, গত দু’মাসে হাওড়াতেই একাকী অবস্থায় মৃত্যুর ঘটনা এই নিয়ে তিনটি ঘটল। একাকী বৃদ্ধবৃদ্ধাদের অস্তিত্ব কেবল সমাজের উচ্চবিত্ত স্তরে, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ঘন সংবদ্ধ পারিবারিকতা বার্ধক্যকে নিঃসঙ্গ হতে দেয় না— এমন একটি ধারণা আগে চালু ছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বয়স্ক মানুষের একা থাকা ও একাকী অবস্থায় মৃত্যু সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে নিয়মিত ঘটনা: হাওড়ার বৃদ্ধা মহিলা অন্যের বাড়িতে রান্নার কাজ করতেন, নিজের বাড়িতে থাকতেন একা। নরেন্দ্রপুরের প্রৌঢ়ার মেয়ে কাছেই থাকতেন, কিন্তু এক বাড়িতে নয়। একই ছাদের তলায়, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকা মানেই যে একাকিত্ব বা অবসাদ গ্রাস করবে না তা নয়, কিন্তু একা থাকা বয়স্ক মানুষের একাকিত্বের বিপদ স্বাভাবিক ভাবেই বেশি। আধুনিক নগরজীবনে ক্রমশ ‘পাড়া সংস্কৃতি’র দখল নিয়েছে তথাকথিত ‘ফ্ল্যাট কালচার’, একক বা গুচ্ছ বহুতল আবাসনগুলিতে জীবন নির্বাহের যাবতীয় সুযোগসুবিধা, বিলাস-ব্যবস্থা, রান্না ও চিকিৎসা পরিষেবা, সর্বোপরি নিরাপত্তার সুবন্দোবস্ত থাকায় প্রবাসে, দূরে বা অন্যত্র থাকা সন্তানপ্রজন্ম মনে করছে, বাবা-মা একা আছেন ঠিকই, কিন্তু একাকী নন। তবু মহানগর থেকে মফস্সলে দরজা ভেঙে উদ্ধার-হওয়া মৃতদেহগুলি প্রমাণ করে, নিঃসঙ্গ বার্ধক্য এক সামাজিক অভিসম্পাত। স্মার্টফোন, আন্তর্জাল, আধুনিকতম প্রযুক্তিতে সেই শাপমোচন হয় না।
অতিমারি এই পরিস্থিতিকে গুরুতর করে তুলেছে কি না, তা নিয়ে কথা হওয়া দরকার। বিগত দু’টি বছরে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও কর্মজীবনে আমূল বদল এসেছে। স্বাস্থ্য-দুর্যোগের জেরে বহু মানুষ ঘরে ফিরতে পারেননি, আবার আপাত-স্বাভাবিকতার আবহে এখন দূরে কর্মস্থলে ফিরছেন অগণিত জন। দুই পরিস্থিতিতেই বিচ্ছেদ এক অমোঘ ধ্রুবক, তার শিকার হচ্ছেন বয়স্ক মানুষেরা, অতিমারির আঘাত ও কর্মমুখর ব্যস্ত জীবন থেকে দূরত্ব তাঁদের শরীর-মনের যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিচ্ছে আরও। যুক্তি ও প্রযুক্তিকে আঁকড়ে ধরা, ধ্রুপদী পারিবারিকতা থেকে মুখ ঘোরানো এই সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে বয়স্করা ক্রমশ গুটিয়ে নিচ্ছেন নিজেদের, স্বগৃহে পরবাসে। সকলেই হয়তো নন, কিন্তু অনেকেই। নয়তো এই করুণ অসহায় মৃত্যুসংবাদগুলি সংবাদপত্রের পাতায় নিয়মিত খবর হয়ে উঠে আসত না।