Lakshmi Bhandar Project

মাইলফলক

উন্নয়ন অর্থনীতির তাত্ত্বিকরা বলিবেন, পরিবারের পুরুষ সদস্যের পরিবর্তে নারী সদস্যের হাতে টাকা তুলিয়া দিলে তাহার সামগ্রিক উন্নয়ন-অভিঘাত বৃহত্তর হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২১ ০৫:৫৯
Share:

দীর্ঘ লাইন, কোভিড-বিধি ভঙ্গ করিয়া ফর্ম জমা করিবার আকুলতা— ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প লইয়া এই উন্মাদনা বিষয়ে একই সঙ্গে দুইটি কথা বলা জরুরি। এক, ইহা রাজ্য প্রশাসনের ব্যর্থতা যে, এই প্রকল্পে নথিভুক্তির প্রক্রিয়াটি সম্বন্ধে সম্যক পরিকল্পনা করা হয় নাই। দুই, এই বিপুল জনসমাগমই বলিয়া দেয় যে, এই গোত্রের একটি প্রকল্পের কতখানি প্রয়োজন ছিল। অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় হইতে রঘুরাম রাজন, কৌশিক বসু— গত দেড় বৎসরে বহু বিশিষ্ট অর্থশাস্ত্রী মানুষের হাতে নগদ টাকা তুলিয়া দিবার গুরুত্বের কথা বলিয়াছেন। যে কাজটি কেন্দ্রীয় সরকারের করণীয় ছিল, রাজ্য সরকার তাহা করিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাধুবাদ প্রাপ্য। উল্লেখ্য যে, এই টাকা পাইবেন কেবলমাত্র পরিবারের মহিলা সদস্যরাই। নারীর হাতে মাসে পাঁচশত হইতে হাজার টাকার ব্যয়ক্ষমতা থাকা পরিবারের পরিসরে তাঁহাদের ক্ষমতায়নের পথে এক বিপুল পদক্ষেপ। উন্নয়ন অর্থনীতির তাত্ত্বিকরা বলিবেন, পরিবারের পুরুষ সদস্যের পরিবর্তে নারী সদস্যের হাতে টাকা তুলিয়া দিলে তাহার সামগ্রিক উন্নয়ন-অভিঘাত বৃহত্তর হয়। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পটি এক তিরে তিনটি লক্ষ্য ভেদ করিতে উদ্যোগী। গত কয়েক বৎসরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সচেতন ভাবেই যে বিকল্প উন্নয়ন নীতির পথে হাঁটিতে চেষ্টা করিতেছেন, তাহার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হইবার সম্ভাবনা ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ নামক প্রকল্পটির আছে।

Advertisement

এক্ষণে একটি প্রশ্ন গুরুতর হইয়া উঠিতেছে— কোন মহিলারা ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ হইতে অর্থসাহায্য পাইবেন, এবং কাহারা বাদ পড়িবেন। এখনও অবধি ছবিটি যতখানি স্পষ্ট হইয়াছে, তাহাতে বোধ হয়, সরকারি চাকুরিরতা মহিলাদের ন্যায় মুষ্টিমেয়কে বাদ রাখিলে বাকি সকলেই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হইবার অধিকারী। অর্থাৎ, প্রকল্পটি কার্যত সর্বজনীন। এই গোত্রের প্রকল্প সর্বজনীন না হইলে সফল হয় না— অযোগ্যদের অন্তর্ভুক্তি, এবং যোগ্যদের অন্তর্ভুক্ত করিবার ব্যর্থতা, উভয় দিক হইতেই ‘টার্গেটেড’ প্রকল্পের বিপদ— এমন একটি যুক্তি আছে। এবং, যুক্তিটি যথাযথ। তাহার তাত্ত্বিক ভিত্তি ও তথ্যগত প্রমাণ, উভয়ই রহিয়াছে। মুশকিল হইল, রাজ্যের আর্থিক সাধ্য সীমিত— অতিমারির কারণে তাহা এক দিকে আরও সঙ্কুচিত হইয়াছে, অন্য দিকে ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা বাড়ায় সীমিত রাজকোষে আরও চাপ পড়িয়াছে। এই অবস্থায় ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পটিকে সর্বজনীন করিবার সাধ্য রাজ্য সরকারের আছে কি না, তাহা ভাবিতে হইবে।

প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তির অন্যতম মাপকাঠি প্রার্থীর আর্থিক অবস্থা হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এই ক্ষেত্রে দারিদ্রসীমাকেই চৌকাঠ হিসাবে বিবেচনা করা যায়। তবে, বর্ণের ন্যায় অন্যান্য কিছু সামাজিক সূচককে গুরুত্ব দিবারও যুক্তি রহিয়াছে। মোট কথা, সীমারেখা টানিতেই হইবে। মুখ্যমন্ত্রী দিনকয়েক পূর্বে জানাইয়াছিলেন, তিনি নাগরিকের সদিচ্ছায় বিশ্বাসী— অর্থাৎ, ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পের অর্থসাহায্য যাঁহার প্রয়োজন নাই, তিনি স্বেচ্ছায় এই প্রকল্পে আবেদন করা হইতে বিরত থাকিবেন বলিয়াই মুখ্যমন্ত্রীর আশা। গণতন্ত্রে নাগরিকের সদিচ্ছা অতি গুরুত্বপূর্ণ বস্তু, কিন্তু তাহার উপর নির্ভর করিয়া নীতি রচনা করা বিপজ্জনক। চাহিলেও সবাইকে যে সাহায্যের প্রাপক করিবার উপায় নাই, সেই সাহায্যের বণ্টন করিতে হইবে প্রয়োজনের তীব্রতার ক্রমানুসারেই। নচেৎ তাহা বৃহত্তর সামাজিক ন্যায়ের পরিপন্থী হইয়া দাঁড়াইবে। যোগ্য প্রাপকদের হাতে যাহাতে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর সাহায্য পৌঁছায়, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে প্রশাসনকেই। নথিভুক্তির প্রক্রিয়া সামলাইতে যে ব্যর্থতার নজির প্রশাসন সৃষ্টি করিয়াছে, তাহার পুনরাবৃত্তি না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement