ঝড় আসিতেছে। প্রচারের ঝড়। কিসের প্রচার? সাফল্যের। কিসের সাফল্য? টিকাকরণের। সরকারি মতে ভারতে কোভিড টিকার একশত কোটি ডোজ় সম্পন্ন হইয়াছে। কেন্দ্রীয় সরকার এই অলোকসামান্য কীর্তি উদ্যাপনে প্রস্তুত। সরকারি বক্তব্যের সার কথা একটিই: ভারত পারে, ভারতই পারে। শুনিয়াই ভক্তজনে মোহিত, কেহ কেহ বোধ করি বাহ্যজ্ঞানরহিত। কিন্তু সত্য কথাটি সাফ সাফ বলিলে— একশত কোটি ডোজ় লইয়া এই শোরগোল একটি অসার এবং হাস্যকর আদিখ্যেতা। প্রথম কথা, দেশের লোকসংখ্যা বেশি হইলে টিকার সংখ্যাও বেশি হইবে, ইহাতে কিছুমাত্র অ-সাধারণত্ব নাই। বস্তুত, চক্ষুলজ্জাটুকুও সম্পূর্ণ বিসর্জন না দিলে এই সংখ্যাটি লইয়া ভারতের পক্ষে গর্ব করা অসম্ভব, কারণ জনসংখ্যায় তাহার সহিত একমাত্র তুলনীয় দেশ চিন অনেক আগেই একশত কোটি ডোজ় টিকা দিবার পালা সাঙ্গ করিয়া ইতিমধ্যে দুইশত কোটির মাত্রাটিও অতিক্রম করিয়াছে। দ্বিতীয়ত, মোট ডোজ়ের সংখ্যা নহে, কত শতাংশ নাগরিক দুইটি ডোজ় পাইয়াছেন সেই সংখ্যাই টিকাকরণের সাফল্য মাপিবার প্রকৃত মাপকাঠি। সেই মাপকাঠিতে ভারতের হাল শোচনীয় বলিলে অত্যুক্তি হয় না, কারণ এই অবধি দুইটি ডোজ় পাইয়াছেন মাত্র সিকিভাগ মানুষ। তৃতীয়ত, আঠারো বৎসর বয়সের নীচে টিকা দিবার কাজ এখনও শুরুই হয় নাই।
ইহার পরেও টিকাকরণের অগ্রগতি লইয়া যেটুকু কৃতিত্ব, তাহা কেন্দ্রীয় সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর একক কৃতিত্ব হইতে পারে না, সেখানে রাজ্য সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের, সর্বোপরি স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্যোগের ভূমিকাই প্রধান। বস্তুত, অতিমারির মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের যে দায়িত্ব ছিল, তাহার কিছুই তাহারা পালন করে নাই। ভ্যাকসিনের অনুমোদন এবং তাহার রফতানি লইয়া তাহাদের অব্যবস্থিতচিত্ততার ইতিহাস এখনও জনস্মৃতিতে তাজা। অপদার্থতা সামাল দিবার তাগিদে দুই ডোজ়ের ব্যবধান বাড়াইবার জন্য বিশেষজ্ঞদের উপর রাষ্ট্রীয় চাপ সৃষ্টির অভিযোগও সর্বজনবিদিত। তদুপরি, সমস্ত নাগরিককে বিনা খরচে টিকা দিবার স্বাভাবিক, সঙ্গত এবং কার্যত আন্তর্জাতিক রীতি লঙ্ঘন করিয়া কেন্দ্রীয় সরকার অতিমারির প্রতিষেধককে আংশিক ভাবে বাজারের পণ্য বানাইয়াছে! এমনকি, প্রতিষেধকের প্রয়োজন সম্পর্কে নাগরিকদের যথেষ্ট সচেতন করিবার কাজটিতেও রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যর্থ— দেশের অনেক অঞ্চলে বহু মানুষ যথাসময়ে টিকার দ্বিতীয় ডোজ় লইতে আসেন নাই, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রককে এই বিষয়ে বৈঠক ডাকিয়া জরুরি নির্দেশ দিতে হইয়াছে। সত্য ইহাই যে, ভারতে কোভিডের টিকাকরণের ইতিহাসটি গৌরবের নহে, লজ্জার।
এই অগৌরবের সত্যটি গোপন করিবার তাগিদেই দিল্লীশ্বরেরা সাফল্যের জয়ঢাক বাজাইতে নামিয়াছেন। একশত কোটি সংখ্যাটি প্রচারের একটি প্রকরণমাত্র। মেকি এবং অন্তঃসারশূন্য প্রচারের ধ্বজা উড়াইয়া জনগণমনকে বিভ্রান্ত করিবার কৌশল নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার বাহিনীর অতি প্রিয়। ২০১৪ সাল হইতে এই কৌশলের অবিরাম প্রদর্শনীই চলিতেছে। কোভিড অতিমারিকেও প্রচারের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিতে তাঁহাদের দ্বিধা বা সঙ্কোচ নাই। সংক্রমণের প্রথম পর্বে দীপ জ্বালাইবার বা থালাবাটি বাজাইবার আহ্বান জানাইয়া প্রধানমন্ত্রী ঘরে ঘরে টেলিভিশনের পর্দায় আবির্ভূত হইয়াছিলেন। অতঃপর কোভিড টিকার শংসাপত্রেও তাঁহার বদনখানি সংলগ্ন হইয়াছে, যেন এই প্রতিষেধক তাঁহার দয়ার দান! ভোটদাতাদের মনে শাসকের মুখচ্ছবি প্রতিষ্ঠিত করিবার এই প্রকল্পেরই নূতন অধ্যায় হিসাবে শুরু হইতেছে একশত কোটির বৃন্দগান। অদূরে উত্তরপ্রদেশ নির্বাচন, সুতরাং গানের তেজ ক্রমে বাড়িবে। রাজভক্তির তাড়নায় যাঁহাদের বোধবুদ্ধি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় নাই, তাঁহারা জানেন, উহা গান নহে, শূন্যকুম্ভের গর্জন।