পূজার আনন্দের অনেকটাই জুড়িয়া রহিয়াছে উপহার পাইবার আনন্দ। রঙিন মোড়কটি হাতে পাইবার সময় হইতে তাহা খুলিয়া দেখিবার মধ্যের সময়টুকু যে আগ্রহের অধীরতা, তাহাই যেন শৈশবের সহিত প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্যের সেতু। উপহারযোগ্য বস্তু কয় প্রকার ও কী কী, সে সকলই যাহার জানা হইয়া গিয়াছে, কিন্তু সেই জানায় উপহার প্রাপ্তির মুহূর্তটির ঔজ্জ্বল্য কমে নাই, তাহা মনের উত্তেজনা দমন করিতে পারে না। নূতন কাপড়টি ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া, আপন গায়ে লাগাইয়া এক বার আয়নায় নিজেকে দেখিয়া লয় মানুষ। জুতাটি আরও এক বার পরখ করিয়া দেখে; পত্রিকা বা বইটি খুলিবার পূর্বে গন্ধ শুঁকিয়া লয়। এক একটি নূতন উপহার যেন মনের শৈবালদাম সরাইয়া মানুষের স্বচ্ছ, অনাবিল অন্তরটি বাহির করিয়া আনে। এমনকি নিতান্ত নিয়মরক্ষার উপহারও হৃদয়কে স্পর্শ না করিয়া যায় না। অকারণ খরচ লইয়া অনুযোগের মধ্যে কখন যেন খুশির সুরটি বাজিয়া উঠে, সংসারের শতছিদ্র যন্ত্রটি কয়েক নিমেষের জন্য সোনার বাঁশি হইয়া দেখা দেয়। উপহারে প্রদত্ত বস্তুটি যাহাই হউক, তাহার বাজারদরকে বহুগুণ ছাপাইয়া যায় তাহার মূল্য। মোড়কের ভিতরে থাকিতে পারে স্বল্পমূল্যের খেলনা, অথবা একটি কলম— কিন্তু দামের স্বল্পতা প্রাপ্তির আনন্দকে কমাইতে পারে না। প্রায় প্রতি পরিবারে কোনও না কোনও বস্তু সযত্নে সংরক্ষিত রহিয়াছে, তাহা উপহারে মিলিয়াছিল বলিয়াই। কে দিয়াছিল, কোন উপলক্ষে, সেই স্মৃতি তাহাকে অমূল্য করিয়াছে। সুগন্ধি ফুরাইলেও তাহার সুন্দর বোতলটি রহিয়া যায়, সন্তানের শৈশবের জামা সযত্নে রক্ষিত হয় তোরঙ্গে। প্রয়োজন ফুরাইলেও তাহাদের দাম কমে নাই। বস্তুত, প্রয়োজনের সঙ্গে যোগ নাই বলিয়াই তাহার মূল্য আরও বাড়ে। ইহাই কি জীবনের ধর্ম নহে? এবং, সেই কারণেই কি জীবন আর একটু বেশি মধুর নহে?
অনেক সময়ে জীবন ফুরাইলেও উপহারের পালা শেষ হয় না। মেরিলিন মনরোর অকালমৃত্যুর পর দীর্ঘ কুড়ি বৎসর তাঁহার সমাধিতে প্রতি সপ্তাহে তিন দিন লাল গোলাপ পাঠাইয়াছেন তাঁহার প্রাক্তন স্বামী জো ডিমাজিয়ো। মাত্র নয় মাস বিবাহিত জীবনের পরে বিচ্ছেদ ঘটিলেও, মেরিলিনের প্রতি চির-অনুরক্ত ছিলেন এই বেসবল তারকা। তবে হলিউডে যে উপহারটি ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছিল, তাহা চৌদ্দ গ্রাম ওজনের সেই হিরা, যাহা এলিজ়াবেথ টেলরকে দিয়াছিলেন রিচার্ড বার্টন। বার্টনের সহিত দ্বিতীয় বার বিবাহ ও বিচ্ছেদের পরে এলিজ়াবেথ হিরাটি বিক্রয়ের অর্থে আফ্রিকার বটসওয়ানা দেশটিকে একটি হাসপাতাল উপহার দেন। সাংবাদিকদের বলিয়াছিলেন, “উহাদের হাসপাতাল প্রয়োজন, আমার আরও একটি গহনার প্রয়োজন নাই।” হিরা যাহার রূপান্তর, সেই কয়লা উপহার দিবার রীতি রহিয়াছে স্কটল্যান্ডে। নূতন বৎসরের উৎসবে অতিথিরা গৃহস্থের জন্য লইয়া আসেন কয়লাখণ্ড— তাঁহার ‘ফায়ারপ্লেস’ যাহাতে ঘর উত্তপ্ত রাখিতে পারে। প্রাচীন ভারতে শিষ্যেরা গুরুর জন্য উপহার আনিত যজ্ঞের কাঠ, বা সমিধ।
তাহা বলিয়া সাংসারিক প্রয়োজন মিটাইবার কাজটি উপহারের প্রকৃত কাজ নহে। উপহার চাঁদা নহে, ঋণ অথবা বিনিময় নহে, দানও নহে। বস্তুত, তাহা প্রয়োজনের জিনিস নহে— নেহাতই ভাল লাগিবার— ইহাই উপহারের মাহাত্ম্য। অতি দুঃস্থ মানুষও অতি বিত্তবানের জন্য উপহার লইয়া আসে, শিশু পড়ুয়া হিজিবিজি আঁকিয়া সোৎসাহে উপহার দেয় শিক্ষককে। উপহার উচ্চ-নীচ, ছোট-বড় ভেদ ঘুচাইয়া মনুষ্যসমাজের এক গভীরতর প্রয়োজন মিটাইয়া থাকে। তাহা অপরের আনন্দে আপন আনন্দ খুঁজিবার প্রয়োজন। কে কাহার কতটুকু কাজে লাগিতে পারে, সে হিসাবের বাহিরে মানবসম্পর্কের যে সুবিশাল জমি পড়িয়া আছে, উপহার তাহার দরজাটি খুলিয়া দেয়। উৎসব তাহার উপলক্ষ হইয়া আসে।