Anis Khan

গভীর অসুখ

নিচুতলার দুই-এক জনকে যূপকাষ্ঠে জুতিয়া দিলেই চলিবে না— পদ-নির্বিশেষে শাস্তি হওয়া জরুরি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২২ ০৪:৫৪
Share:

আনিস খানের মৃত্যুকে কেন্দ্র করিয়া পুলিশের দিকে অভিযোগের যে তর্জনী উঠিল, তাহা এই প্রথম বার নহে। ইহাই শেষ বার, এমন দুরাশা করিবার সাহসও রাজ্যবাসীর হয় না। যাঁহাদের হাতে আইনরক্ষার ভার, তাঁহাদের বে-আইনের পথে চলিবার দৃষ্টান্ত এই রাজ্যে দুর্ভাগ্যবশত এমনই সুলভ যে, সেই ঘটনাগুলিকে ব্যতিক্রমী বলিবার কোনও উপায় নাই। আনিস খানের মৃত্যু কী কারণে, কী ভাবে হইল, তাহা এখনও তদন্তসাপেক্ষ— কিন্তু, তাহার পিছনে পুলিশের ভূমিকার যে অভিযোগ উঠিয়াছে, যে ভাবে দুই পুলিশকর্মী গ্রেফতার হইয়াছেন, এবং যে ভাবে তাঁহারা উপরমহলের চাপের অভিযোগ করিয়াছেন, তাহাতে স্পষ্ট যে, গোটা ব্যবস্থায় গভীর সমস্যা রহিয়াছে। সমস্যাটি কাঠামোগত— গোটা ব্যবস্থায় ঘুণ ধরিয়াছে। এই পাপটি একান্ত ভাবে বর্তমান জমানার, বলিলে ভূতপূর্ব নগরপাল প্রসূন মুখোপাধ্যায় ঘোর আপত্তি করিতে পারেন। তাঁহার আমলেও বে-আইনের পথে চলিবার কাজটি সেচ অথবা পিডব্লিউডি নহে, পুলিশই করিত। রোগ তখন যাহা ছিল, এখনও তাহাই। বড় জোর তাহার প্রকোপ বাড়িয়াছে। সেই রোগের প্রথম কারণ, পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার। যখন যে দল ক্ষমতায়, সেই দল তখন পুলিশকে কার্যত দলের লেঠেল বাহিনী হিসাবে ব্যবহার করিবে, ইহাই পশ্চিমবঙ্গের দস্তুর। অভ্যাস বিষম বস্তু, ফলে নিচুতলার পুলিশকর্মীরা ভুলিয়াছেন যে, তাঁহারা দলের চাকুরি করেন না। শাসক দলের মেজো-সেজো নেতাদের নির্দেশে চলাকেই তাঁহারা দায়িত্ব ঠাওরান।

Advertisement

দ্বিতীয় সমস্যা, পুলিশের মধ্যে সচেতনতার অভাব। তাঁহাদের চাকুরির উদ্দেশ্য-বিধেয় কী, অধিকাংশ পুলিশকর্মীরই সে বিষয়ে সম্যক ধারণা নাই বলিয়া আশঙ্কা হয়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অমর উক্তি রাজ্যবাসীর স্মরণে থাকিতে পারে— মানবাধিকার-টাধিকার আমি বুঝিয়া লইব। বর্তমান শাসকরাও যে ভিন্নতর ধারণা পোষণ করেন, তেমন সন্দেহ করিবার উপায় নাই। ফলে, নিজের কর্তব্যের গণ্ডি, এবং অকর্তব্যের পরিধি বিষয়ে পুলিশকর্মীদের ধারণা ক্ষীণ। রাস্তাঘাটে চড়থাপ্পড় মারা হইতে থানায় নিগ্রহ, পুলিশ সবই করিয়া থাকে। কোনও ক্ষেত্রে হাজতে অত্যাচার মাত্রা ছাড়াইলে দিনকয়েক হইচই হয়, তাহার পর যথা পূর্বং। তাহার উপর যোগ হইয়াছে সিভিক ভলান্টিয়ারদের দৌরাত্ম্য। খাতায়কলমে তাঁহারা পুলিশ নহেন, কিন্তু দাপটে দ্বিগুণ, আইন ভাঙিতে চতুর্গুণ। খাস কলিকাতায় এক নাগরিকের বুকে পদাঘাত করিয়াছিলেন এক সিভিক ভলান্টিয়ার, সেই ঘটনা ভুলিবার পূর্বেই আনিস খানের মৃত্যুতেও সিভিক ভলান্টিয়ারদের নাম জড়াইল।

নাগরিকের সহিত পুলিশের সম্পর্ক যে ফুটবল খেলিয়া তৈরি হইবে না, বাড়ি বাড়ি গিয়া প্রবীণ নাগরিকদের কুশল সংবাদ গ্রহণেও নহে, এই কথাটি এত দিনে প্রশ্নাতীত রকম স্পষ্ট। প্রয়োজন পুলিশবাহিনীর সংস্কারের। তাহার প্রথম ধাপ, পুলিশকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হইতে মুক্তি দেওয়া। কাজটি বিলক্ষণ কঠিন— বর্তমান ভারতে তাহা দিনে-রাতে কঠিনতর হইতেছে, তাহাও ঠিক। কিন্তু, যত ক্ষণ না পুলিশবাহিনী রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বাহিরে, স্বনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করিতে পারিতেছে, তত ক্ষণ অবধি বাহিনীর অভ্যন্তরে ক্লায়েন্টেলিজ়ম-এর সমস্যা মিটিবার নহে। দ্বিতীয়ত, পুলিশকর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। চুলবুল পান্ডে বা সিম্বা যে অনুকরণীয় আদর্শ নহে, এই সহজ কথাটি তাঁহাদের বুঝাইতেই হইবে। তৃতীয়ত, তাহার পরও যে পুলিশকর্মীরা নিজেদের অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করিবেন, তাঁহাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা হওয়া প্রয়োজন। নিচুতলার দুই-এক জনকে যূপকাষ্ঠে জুতিয়া দিলেই চলিবে না— পদ-নির্বিশেষে শাস্তি হওয়া জরুরি। মানুষ পুলিশকে ভরসা করিতে পারে না, এই অবস্থার অবিলম্বে পরিবর্তন প্রয়োজন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement