প্রতীকী ছবি।
বড়লোক হইবার সহজ উপায়: আজ রাত্রিতে পেট্রল কিনুন, কাল সকালে বেচুন— লিটারপ্রতি নিদেনপক্ষে ২০-৩০ পয়সার মুনাফা বাঁধা! দীপাবলির প্রাক্-মুহূর্তে পেট্রল-ডিজ়েলের উপর উৎপাদন শুল্ক কমাইয়া কেন্দ্রীয় সরকার সোশ্যাল মিডিয়ায় হাতে হাতে ফেরা এই রসিকতাটির পালের বাতাস কাড়িয়া লইল বটে, কিন্তু তাহাতে সত্যটি ঢাকা পড়িবে না। সত্য ইহাই যে, সরকারের শুল্ক হ্রাসের ঘোষণার আগে পর্যন্ত কার্যত প্রতি দিন পেট্রল-ডিজ়েলের দাম বাড়িতেছিল। তবে, গত দেড় বৎসরে এই প্রথম তেলের মূল্যবৃদ্ধির দায়টি সম্পূর্ণত কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপে নাই। সরকারের মুখপাত্রও কম্বুকণ্ঠে সেই কথাটি জানাইতে ভুলেন নাই— দেশের বাজারে পেট্রল-ডিজ়েলের দাম প্রবল বেগে ঊর্ধ্বমুখী, কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে আগুন লাগিয়াছে। গত বৎসর এপ্রিলে ব্যারেলপ্রতি দাম ছিল ১৬ ডলারের কাছাকাছি— এক বিশেষ ক্ষেত্রে ঋণাত্মক দামেরও রেকর্ড সৃষ্টি করিয়াছিল। সেই অপরিশোধিত পেট্রোলিয়ামের দামই এখন ব্যারেলপ্রতি ৮৫ ডলারের কাছাকাছি। এক্ষণে অবশ্য প্রশ্ন করা বিধেয় যে, কেন্দ্রীয় সরকার উৎপাদন শুল্কের পরিবর্তে সেস-এর পরিমাণ কমাইল না কেন? প্রথম খাত হইতে আদায় করা টাকায় রাজ্য সরকারগুলির ভাগ আছে, দ্বিতীয় খাতের রাজস্বে নাই, এই কারণেই কি? অবশ্য, তুমুল চড়া করের হার খানিক ছাঁটিয়া যে সরকার তাহাকে দীপাবলির উপহার বলিবার ধৃষ্টতা দেখায়, তাহার নিকট এই প্রশ্নের সদুত্তর মিলিবে না।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়িতেছে বহুবিধ কারণে। প্রথমত, অতিমারির ধাক্কা সামলাইয়া বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমে ছন্দে ফিরিতেছে। ফলে, পেট্রো-পণ্যের চাহিদা বাড়িয়াছে। দ্বিতীয়ত, প্রতি শীতেই পেট্রোলিয়ামের চাহিদা বাড়ে, ফলে মূল্যস্তরের উপর তাহার প্রভাবও পড়ে। তৃতীয় কারণ, তেল উৎপাদনকারী দেশগুলির সংগঠন ‘ওপেক’ ধীরগতিতে উৎপাদন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত লইয়াছে। গত বৎসর তেলের দাম তলানিতে থাকায় তাহাদের যে আর্থিক ক্ষতি হইয়াছে, এই বৎসরের চড়া মূল্যস্তর ধরিয়া রাখিয়া সেই ঘাটতি পুষাইয়া লওয়াই তাহাদের আন্তর্জাতিক বাজার সেই ইঙ্গিত পাঠ করিয়াছে, ফলে তেলের দাম গত দেড়-দুই মাসে তীব্র গতিতে বাড়িল। তাহাতে ভারতের ন্যায় দেশের বিপদ। এক দিকে দেশের বাজারে পেট্রো-পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হইলে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হারে তাহার প্রভাব পড়ে, কারণ অধিকাংশ পণ্যের ক্ষেত্রেই পরিবহণ ব্যয় তাহার মূল্যের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ। অন্য দিকে, ভারত যে হেতু বিপুল পরিমাণ পেট্রো-পণ্য আমদানি করে, ফলে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়িলে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণও বাড়িতে থাকে। ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম কমে। তাহাতে টাকায় পেট্রো-আমদানির খরচ আরও বাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সাধ্য কোনও একক ক্রেতা দেশের নাই। ওপেক দেশগুলির ধীরে চলিবার নীতি বিষয়ে ভারত নিজের আপত্তি জানাইয়াছে, কিন্তু তাহাতে খুব সুবিধা হইবে, তেমন আশা কম। তবে, দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সামলাইবার একটি পথ সরকারের নিকট ছিল— বিলম্বে হইলেও উৎপাদন শুল্ক কমাইবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়া কেন্দ্রীয় সরকার সেই পথে হাঁটিয়াছে। ইহা অনস্বীকার্য যে, পেট্রো-পণ্যের উপর আদায় করা শুল্ক কেন্দ্রীয় রাজস্বের একটি বড় অংশ— তাহাতে টান পড়িলে সরকারের সমস্যা বাড়িবে বই কমিবে না। কিন্তু দেশ যখন কোভিডের বিপর্যয় হইতে ঘুরিয়া দাঁড়াইবার চেষ্টা করিতেছে, তখন বর্ধিত তেলের দাম-জনিত মূল্যস্ফীতিকে সেই পথের বাধা হইতে দেওয়াও বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হইত না। এক্ষণে সরকার ভাবিতে পারে, আন্তর্জাতিক মূল্যস্তরের সহিত শুল্কের পরিমাণের উঠা-নামার একটি নীতি বাঁধিয়া দেওয়া যায় কি না। দেশের বাজারে তেলের দাম খানিক স্থিতিশীল হইলে অর্থব্যবস্থার উপকার হইবে।