Communalism

শাসকের মন

প্রশাসন ও তাহার সহযোগী দল-গোষ্ঠী তথা ‘এজেন্সি’গুলির সক্রিয়তা, অতিনিয়ন্ত্রণ, ঔদাসীন্য বা নিষ্ক্রিয়তা শাসকেরই মানসিকতার প্রতিফলন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৪:৪৩
Share:

লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, আইনজ্ঞ-সহ বিশিষ্টজন খোলা চিঠি লিখিলেন কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাইকে, রাজ্যের সংখ্যালঘুদের উপরে ক্রমবর্ধমান হিংসার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া। গত কয়েক মাসে কর্নাটকের বিভিন্ন জেলায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভীতি প্রদর্শন ও প্রার্থনাসভা পণ্ড করিবার ঘটনা ঘটিয়াছে, হইয়াছে সংঘর্ষ ও নীতিপুলিশির বাড়বাড়ন্ত, সম্মান রক্ষার্থে হত্যাও। প্রশাসন বা সরকারের যাহা করা উচিত, সেই উত্তেজনা প্রশমন বা হিংসা দমনের পরিবর্তে আইন-প্রণেতারা নিজেরাই মাতিয়াছেন নারীবিদ্বেষী বা অসংসদীয় মন্তব্যে, এমনকি ঘৃণাভাষণেও। আক্কা মহাদেবী, বাসবান্না, কনকদাস, পুরন্দরদাসেরা যে রাজ্যের আদর্শ, কুভেম্পু-দত্তাত্রেয় বেন্দ্রের মানবতাবাদী সাহিত্য যে রাজ্যের বহুত্ববাদী ভিত্তিকে স্থিতি দিয়াছে, হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী ও সমাজবিরোধী দুর্বৃত্তদলের আক্রমণে সেই রাজ্যেই পরমতসহিষ্ণুতা ক্রমশ মুছিয়া যাইতেছে।

Advertisement

সমাজমান্যদের পত্রসূত্রে সংখ্যালঘুদের উপর অন্যায়ের প্রতিবাদের পাশাপাশি অন্য একটি বিষয়ও সমগুরুত্বে স্থান পাইয়াছে— প্রশাসনের ইতিকর্তব্য। সরকার কোন কাজগুলি করিলে তাহা প্রকৃষ্ট শাসন তথা ‘প্রশাসন’ হইয়া উঠে, তাহা। প্রশাসককে সর্বাবস্থায় আইনের শাসন, নাগরিকের অধিকার ও মানবিকতাবোধের মৌলিক আবহটি নিশ্চিত করিতে হয়, বৃহত্তর পরিসরে তাহা ভারতের সংবিধান-স্বীকৃত মূল্যবোধ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সার্থকতাকেই সূচিত করে। অথচ প্রশাসকদেরই তাহা বুঝাইয়া পারা যাইতেছে না, বা বারংবার মনে করাইয়া দিতে হইতেছে। গত বৎসর অক্টোবরে খোদ কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী ‘হেট ক্রাইম’-এর ঘটনাকে ‘ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া’ বলিয়াছিলেন, সমাজে নৈতিকতা বজায় রাখিতে নীতিপুলিশির পক্ষে সওয়াল করিয়াছিলেন। সমাজমানসে প্রবল আলোড়ন উঠিয়াছিল, প্রতিবাদ করিয়াছিলেন সমাজকর্মী, দলিত সংখ্যালঘু মানুষ, নারীরা। পরিস্থিতি যে বদলায় নাই, সাম্প্রতিক পত্র-প্রতিবাদই প্রমাণ। বিধানসভার বাদল অধিবেশনে বোম্মাই সরকার ধর্মান্তরণ বিরোধী আইনের প্রস্তাব করিবার পরেই কর্নাটক জুড়িয়া গির্জায় হামলা, খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের উপর হেনস্থা ও অত্যাচার মাত্রা ছাড়াইয়াছিল, বেঙ্গালুরুর আর্চবিশপ তখনও রাজ্য সরকারের ‘মানসিকতা’ লইয়া প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন।

শাসকের এই মানসিকতার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রশাসন ও তাহার সহযোগী দল-গোষ্ঠী তথা ‘এজেন্সি’গুলির সক্রিয়তা, অতিনিয়ন্ত্রণ, ঔদাসীন্য বা নিষ্ক্রিয়তা শাসকেরই মানসিকতার প্রতিফলন। কর্নাটকে সামাজিক সুস্থিতি রক্ষায় শাসকের ‘মন’ নাই বলিয়াই হিংসার ঘটনাগুলি ঘটিতেছে। সমধর্মী ভূরি উদাহরণ অন্য রাজ্যেও, শুধু আক্রান্তের ধর্ম গোষ্ঠী বা রাজনীতি-পরিচয় সেখানে ভিন্ন। বিদ্বজ্জনেরা চিঠিতে ইহাও মনে করাইয়া দিয়াছেন, সুস্থ সামাজিক পরিবেশ না থাকিলে রাজনীতি তো বটেই, অর্থনীতিরও ক্ষতি— লগ্নি হইতে শুরু করিয়া বৃহৎ শিল্প-সম্ভাবনা, সবই অন্য ঠিকানা খুঁজিয়া লইবে। প্রশাসন যে ইহা জানে না তাহা নহে, তবু জাতি ধর্ম সম্প্রদায় লইয়া সমাজে ভেদবুদ্ধি ও হিংসা নির্মূল করিতে দৃঢ়সঙ্কল্প হয় না। কর্নাটকের উদাহরণ হইতে অন্য রাজ্যগুলি তাই কিছু শিখিবে কি না, সেই সংশয় থাকিয়া যাইতেছে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement