—প্রতীকী ছবি।
হাসপাতালে ভর্তি না-হলে মানুষ প্রাণে মারা যায়, আর হাসপাতালে ভর্তি হলে ধনে-প্রাণে— মুখফেরতা এই রসিকতাটির মধ্যে সত্যের ভাগ ক’আনা, বাস্তব তা অনেককেই শিখিয়েছে। চিকিৎসার ক্রমবর্ধমান ব্যয় সামলানোর একটিমাত্র পন্থা মানুষের সামনে রয়েছে, তার নাম স্বাস্থ্যবিমা। তবে, এত দিন বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়ম অনুসারে ৬৫ বছরের বেশি বয়স্ক নাগরিকের আর নতুন স্বাস্থ্যবিমা কেনার অধিকার ছিল না। সে বয়সে পৌঁছনোর আগেই যাঁদের স্বাস্থ্যবিমা ছিল, তাঁরা বছর বছর চুক্তি নবীকরণ করাতে পারতেন, কিন্তু যাঁর বিমা নেই, তিনি নতুন বিমা কিনতে পারতেন না। সম্প্রতি একটি নির্দেশ জারি করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই নিয়মটি পাল্টাল। শুধু তা-ই নয়, নতুন নিয়ম হল যে, বিমা কেনার আগে কোনও রোগ থাকলে সেই রোগের চিকিৎসার ব্যয়ও এই বিমার আওতায় আসবে।
এই নিয়ম পরিবর্তন বহু মানুষকে স্বস্তি দেবে। কেন এত দিন নিয়মটি অন্য রকম ছিল, সে প্রশ্নের একটি সরল উত্তর আছে— বয়স বাড়লে মানুষের রোগব্যাধির সম্ভাবনাও বাড়ে, ফলে বিমায় প্রত্যাশিত খরচের পরিমাণও বাড়ে। ফলে, একটি নির্দিষ্ট বয়স পেরিয়ে গেলে প্রিমিয়ামের টাকায় সেই ঝুঁকি সম্পূর্ণত ঢাকা সম্ভব হয় না। অতএব, ৬৫ বছরের বেশি বয়স হলে আর নতুন পলিসি বিক্রি করা হত না। অনিশ্চয়তার অর্থশাস্ত্রের এই সরল যুক্তিটির সঙ্গে নৈতিকতার বিরোধটি অনতিপ্রচ্ছন্ন— বিশেষত ভারতের মতো দেশে, যেখানে স্বাস্থ্যবিমার ধারণাটিই তুলনামূলক ভাবে নতুন। অর্থনীতির উদারীকরণের সূত্র ধরে এ দেশে স্বাস্থ্যবিমার চল হয়েছিল বটে, কিন্তু দীর্ঘ দিন তা সীমাবদ্ধ ছিল মূলত শহরাঞ্চলে, অর্থনৈতিক ভাবে সচ্ছল জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এখনও গ্রামাঞ্চলে, তুলনামূলক ভাবে অসচ্ছল পরিবারে, অপেক্ষাকৃত স্বল্পশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্যবিমার চলন অতি সীমিত। এই অবস্থায় বিমায় বয়সের ঊর্ধ্বসীমা থাকলে তা জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের প্রতি বিরূপতা। বিশেষত, যাঁরা এখনও স্বাস্থ্যবিমার আওতার বাইরে, প্রকৃতার্থে এই বিমা তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন— কারণ আধুনিক চিকিৎসার ব্যয় যেখানে পৌঁছেছে, পকেটের টাকায় তা সামাল দেওয়ার মতো পকেটের জোর দেশের বেশির ভাগ মানুষেরই নেই। তবে লক্ষণীয়, নতুন নির্দেশে এ কথাটিও জুড়ে দেওয়া হয়েছে যে, অতঃপর আয়ুর্বেদ, ইউনানির মতো চিকিৎসা ব্যবস্থাতেও স্বাস্থ্যবিমার সুবিধা পাওয়া যাবে। এই প্রাক্-আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতিগুলিকে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের সমগোত্রীয় করে তুলতে সরকারের উৎসাহ প্রশ্নাতীত।
৬৫ বছরের বেশি বয়সি নাগরিকদের জন্য বিমার দরজা খুলে দেওয়ার পরও অবশ্য বাধা থাকে। সেই বাধার নাম প্রিমিয়াম। বয়স বাড়লে ঝুঁকি বাড়ে, ফলে প্রিমিয়ামও বাড়ে। কিন্তু, সেই প্রিমিয়ামের অঙ্ক যদি বেশির ভাগ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, তা হলে বিমার দরজা খুললেও লাভ হবে না। জানা গিয়েছে, অবস্থাবিশেষে কিস্তিতে প্রিমিয়াম প্রদানের সুবিধা মিলবে। কিন্তু, তা যথেষ্ট হবে না বলেই আশঙ্কা হয়। তেমন পরিস্থিতিতে প্রবীণ নাগরিকদের প্রিমিয়ামে ভর্তুকি দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। নবীনতর জনগোষ্ঠীর প্রিমিয়াম থেকেও সেই ভর্তুকির টাকার ব্যবস্থা হওয়া সম্ভব। স্বাস্থ্য সবার অধিকার, ফলে টাকার অভাবে কেউ যাতে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন, তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।