যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতিতে শিক্ষার বিষয়টি নির্ধারণ করার কথা হয়েছিল সংবিধানে। ফাইল চিত্র।
ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব যে যে ক্ষেত্রে সম্যক ভাবে টের পাওয়ার কথা, তার মধ্যে অন্যতম— শিক্ষা। সংবিধানের যৌথ তালিকায় শিক্ষাকে রাখার সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হয়েছিল, তার কারণটি অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। এত বড় মাপের একটি দেশে শিক্ষা-পরিচালনার নীতি ও পদ্ধতিসমূহ পুরোপুরি কেন্দ্রের উপর ছেড়ে দিলে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যটিই বিঘ্নিত হতে পারে। আঞ্চলিক ভাষা-সংস্কৃতি-সত্তাবোধ বিপন্ন হতে পারে, আঞ্চলিক ইতিহাস-ভূগোলও অবহেলিত হতে পারে। কেবল কী পড়ানো হচ্ছে, সেটাই একমাত্র প্রশ্ন নয়, কী ভাবে পড়ানো হচ্ছে, তা-ও গুরুত্বপূর্ণ, এবং তার জন্য আংশিক ভাবে বিকেন্দ্রিত ব্যবস্থার বিকল্প নেই। এই কারণেই কতকগুলি সাধারণ নীতির সঙ্গে রাজ্যভিত্তিক পরিচালনাকে যুক্ত করা খুব জরুরি বলে মনে করা হয়েছিল। তাতে ফল যে খুব খারাপ হচ্ছিল, এমনও মনে করার কারণ নেই। স্বাধীনতার পরের কয়েক দশকে শিক্ষার হার ও প্রসার যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক ছিল। যে সংস্কার দরকার ছিল, তার জন্য শিক্ষার মূল চরিত্রটিকে নষ্ট করার কারণ ছিল না। স্পষ্টতই বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সেই প্রচলিত সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত নয়। নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে তাই তৈরি হল নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি। কেন্দ্রীয় সরকারের মতে এই নীতি শিক্ষাকে ভবিষ্যতোপযোগী (ফিউচারিস্টিক) ও ভারতীয়কৃত (ইন্ডিয়ানাইজ়ড) করতে চলেছে। অন্য দিকে বিরোধীদের মতে, এই নতুন নীতির প্রধান লক্ষ্য হয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে অকারণ কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ, গৈরিকীকরণ ও দ্রুত হারে বেসরকারিকরণ। আপত্তি উঠেছে বেশ কয়েকটি রাজ্য থেকে, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ু অগ্রগণ্য। অবশ্য সব প্রতিবাদকেই প্রান্তিক করে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। ভারতীয়ত্ব ও গৈরিকতার সম্পর্ক নিয়ে ইতিমধ্যে বহু চর্চা ও সমালোচনা পরিচিত, আরও অনেক শোনা যাবে। কিন্তু আবারও জোরালো আপত্তি তোলা জরুরি— দেশের শিক্ষাব্যবস্থার যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্রটি বিনাশের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে।
কথাটি আবার উঠছে, কেননা সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষানীতি রূপায়ণের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক, বেসরকারি ও ডিমড বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে যে পাঁচটি উপাচার্য কমিটি তৈরি করেছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গের এক জনও উপাচার্য নেই। অথচ, পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের কোনও শিক্ষাবিষয়ক কমিটি হবে, আর তাতে অগ্রগণ্য পশ্চিমবঙ্গীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি প্রতিনিধিত্ব পাবে না— এই ভাবনাটিই হাস্যকর, আপত্তিকর। স্মরণ না করে উপায় নেই, দেশের সার্বিক তালিকায় অন্তত দু’টি পশ্চিমবঙ্গীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ ভাবে এগিয়ে— যাদবপুর ও কলকাতা। ফলত, এই ঘটনার মধ্যে বঙ্গ-বর্জনের কৃৎকৌশলটি পরিষ্কার। পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিক্ষানীতির প্রতিবাদ উঠেছে সজোরে, জাতীয় শিক্ষানীতি পর্যালোচনার জন্য উচ্চপর্যায়ের কমিটিও তৈরি হয়েছে গত এপ্রিলে। তাই এই পাল্টা দাওয়াই। রাজনীতির রং ছাড়া এর মধ্যে আর কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
প্রকৃতপক্ষে ঠিক এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতিতে শিক্ষার বিষয়টি নির্ধারণ করার কথা হয়েছিল সংবিধানে। রাজ্যগুলির দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থান যাতে উপেক্ষিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে। এবং কোনও একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যেন গোটা দেশকে আত্মসাৎ করে না ফেলে, তা নিশ্চিত করতে। এ আজ আর নতুন কথা নয় যে, ‘ভারতীয়করণ’ বলতে বিজেপি যা বোঝে, সেটাই ভারত ও ভারতীয়তার একমাত্র অর্থ নয়। অথচ, দেশের মানুষকে ওই একটি অর্থই মানতে বাধ্য করা হচ্ছে। ইউজিসি-র ইতিহাস পাঠ্যক্রম সংশোধনই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রবর্তিত হলে বিজেপি-ভারত প্রকল্প এক লাফে কয়েক ধাপ এগোনো যাবে, সেটাই প্রতিবাদ-পরিহারের রাজনীতির মূলে।