OTT platform

ফাঁস

কিন্তু, অভিজ্ঞতা বলিতেছে, সেই অপব্যবহারের সিংহভাগই হইয়াছে বর্তমান শাসকপক্ষের সহিত সংস্থার কর্তৃপক্ষের আঁতাঁতের ফলে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০২১ ০৬:২৪
Share:

উভয়ই শ্রাব্য-দৃশ্য মাধ্যম। উভয়েরই মূল উদ্দেশ্য বিনোদন। সুতরাং, কাণ্ডজ্ঞান বলিবে, উভয় ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণের একই নিয়মবিধি প্রযোজ্য হওয়া বিধেয়। কেন্দ্রীয় সরকার এই কাণ্ডজ্ঞানটিকে স্বীকার করিতে নারাজ। ফলে, চলচ্চিত্রের জন্য সেন্সর বোর্ড-এর ব্যবস্থা থাকিলেও ‘ওভার দ্য টপ’ বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলির জন্য নূতন তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ব্যবস্থা হইল। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সরাসরি দর্শকের নিকট বিনোদন পৌঁছাইয়া দেওয়ার এই পথটি নূতন। তাহাতে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না থাকায় সেই পরিসরে হিংস্রতা ও যৌনতা প্রদর্শনের বাড়াবাড়ি ঘটিয়া থাকে, তাহাও অস্বীকার করিবার উপায় নাই। কিন্তু, সেই পরিসরের বিনোদনকে সেন্সর বোর্ডের অধীনে আনিলেই এই নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা যাইত। তাহার জন্য নূতন আইনের ব্যবস্থা হইল কেন? কেহ সন্দেহ করিতে পারেন, হিংস্রতা বা যৌনতা সরকারি উদ্বেগের মূল কারণ নহে— ইদানীং কালে ভারতে নির্মিত বেশ কিছু ওটিটি অনুষ্ঠানে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ক যে তির্যক মন্তব্য রহিয়াছে, সরকার তাহাতেই বিচলিত। ‘ভাবাবেগে আঘাত’ লাগিবার অজুহাতে ইতিমধ্যেই হিন্দুত্ববাদী নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়াটি শুরু হইয়া গিয়াছে। নূতন আইন তৈরি করিলে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলি সতর্ক হইবে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের পথে হাঁটিবে, এমন একটি আশাও অমূলক নহে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বস্তুটি ভারতে ক্রমেই অলীক হইতেছে। ইনফর্মেশন টেকনোলজি (ইন্টারমিডিয়ারি গাইডলাইনস অ্যান্ড ডিজিটাল মিডিয়া এথিকস কোড) রুলস, ২০২১— দেশকে সেই পথেই আরও এক ধাপ লইয়া যাইবে, এই আশঙ্কা অনিবার্য।

Advertisement

সমাজমাধ্যম সংস্থাগুলিও এই নূতন আইনের আওতায় আসিয়াছে। সাম্প্রতিক কালে ভারতে সমাজমাধ্যমের এমনই অপব্যবহার হইয়াছে যে, তাহাতে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা লইয়া সংশয় নাই। কিন্তু, অভিজ্ঞতা বলিতেছে, সেই অপব্যবহারের সিংহভাগই হইয়াছে বর্তমান শাসকপক্ষের সহিত সংস্থার কর্তৃপক্ষের আঁতাঁতের ফলে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিদ্বেষমূলক প্রচারে রাশ টানা হয় নাই; অন্য দিকে, প্রতিবাদী কণ্ঠ রোধ করা হইয়াছে। এই অবস্থায়, নজরদারির দায়িত্বটি যদি কোনও প্রকৃত নিরপেক্ষ সংস্থার উপর ন্যস্ত না হয়— যদি সংস্থাগুলিকে স্বনিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়, বা বিচারের অধিকারটি সরকার পক্ষের হাতে থাকে— তাহা হইলে নিয়ন্ত্রণ কথাটিই অর্থহীন হইয়া দাঁড়ায়। এখন যে ভঙ্গিতে নাগরিকের বাক্‌স্বাধীনতা খর্ব করিবার প্রয়াস চলে, এই নিয়ন্ত্রণ বড় জোর তাহাকে আরও বেশি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিবে। এক্ষণে প্রশ্ন, প্রকৃত নিরপেক্ষ কোনও প্রতিষ্ঠান কি ভারতে আদৌ সম্ভব? এমন প্রতিষ্ঠান, যাহা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের চাপটিকে অস্বীকার করিতে পারিবে; সংবিধান দেশের নাগরিকদের যে অধিকার দিয়াছে, তাহা রক্ষা করিতে প্রকৃতই সচেষ্ট হইবে?

তেমনই একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হইবার কথা ছিল প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া-র। সরকার জানাইয়াছে, ডিজিটাল সংবাদ সংস্থাগুলিকে প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার ‘এথিকস কোড’ মানিয়া চলিতে হইবে। আপাতদৃষ্টিতে তাহা সংবাদ সংস্থার স্বাধীনতার পক্ষেই সওয়াল করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিবে, প্রেস কাউন্সিল নামক প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হইয়াছিল রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় রোষ হইতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে রক্ষা করিবার উদ্দেশ্যেই। কিন্তু, তাহারা সেই দায়িত্ব পালন করিতে ব্যর্থ হইয়াছে, বলিলে সম্পূর্ণ বলা হয় না। রাষ্ট্রীয় খবরদারির নিকট নতিস্বীকার করিবার যে প্রবণতা ভারতের যাবতীয় ‘নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান’কে গ্রাস করিয়াছে, প্রেস কাউন্সিলও তাহারই শিকার। ফলে, তাহার নজরদারিতে বাক্‌স্বাধীনতার উদ্‌যাপন হইবে বলিয়া আশা হয় না। নিয়ন্ত্রণের ফাঁসটি আরও চাপিয়া বসিতেছে, ইহাই ভারতের অনস্বীকার্য বাস্তব।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement