—ফাইল চিত্র।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি জরুরি কাজ শুরু করেছেন। জুলাইয়ের গোড়া থেকে দণ্ড সংহিতা নামে যে তিনটি আইন (ন্যায় সংহিতা, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা
সংহিতা, ভারতীয় সাক্ষ্য বিধান) চালু হওয়ার কথা, সেগুলিকে কার্যকর করার দিন পিছিয়ে দিয়ে আবার নতুন করে আলোচনা ও পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়ে নতুন মন্ত্রিসভার কাছে চিঠি দিয়েছেন। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই পুনর্বিবেচনা। ব্যতিক্রমী হলেও এই ক্ষেত্রে পুনর্বিবেচনা চাই, কেননা, প্রথমত, একটি (গণতান্ত্রিক) রাষ্ট্রের দণ্ডবিধির উপর সে দেশের মঙ্গলামঙ্গল, ও সর্বোপরি, নাগরিক অধিকারের বিষয়টি প্রবল ভাবে নির্ভরশীল। দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ ভারতের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এই আইনধারাগুলি স্বাধীন দেশে প্রচলিত হয়েছিল, এবং আজকের পরিবর্তনের হেতু হিসাবে সেই ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আসার কথাই শোনা গিয়েছিল। কার্যক্ষেত্রে অবশ্য দেখা যাচ্ছে, সে লক্ষ্য মোটেই সাধিত হয়নি। সুতরাং নাগরিক মননে এই প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, তা হলে এত পরিবর্তনের ঘনঘটা কেন। এবং তৃতীয়ত, বহু ক্ষেত্রেই সংশয়ের অবকাশ আছে যে, নতুন দণ্ডবিধিতে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রসারিত হওয়ার বদলে অনেক বেশি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। বিগত সরকারের আমলে যে এ বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ দেখা যায়নি, তাতে অস্বাভাবিকতা নেই। বিরোধী সংখ্যা অতি সীমিত থাকার কারণে মোদীতান্ত্রিক প্রায়-একদলীয় সরকারের যে রূপ গত লোকসভায় দেখা গিয়েছিল, তাতে যে-কোনও প্রস্তাবই অতি দ্রুতবেগে বিনা আলাপ-আলোচনায় ভক্তিবেগের জোরে আইন হিসাবে পাশ হয়ে যাওয়ার একটি অ-সাধারণ প্রবণতা তৈরি হয়েছিল, সে কথা এখন সর্বজনজ্ঞাত।
কিন্তু দেশের মেরুদণ্ডসমান যে আইনকাঠামো, তাতে অগণতন্ত্রের এই ধ্বজা উড্ডয়ন এবং নাগরিক অধিকার হ্রাসের এমন আশঙ্কা বর্ধন একেবারেই সহনীয় বা সমর্থনীয় নয়। সুতরাং প্রয়োজনে, সব রকম প্রচলিত ধারার বিপরীতে গিয়েও, দণ্ড সংহিতা, বিশেষত ন্যায় সংহিতার পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন— এ বারের শাসক-বিরোধী যুগ্মপক্ষের ভারসাম্যযুক্ত লোকসভা মঞ্চে। বিরোধী নেতৃবর্গ এ নিয়ে একমত, একসুর এবং উচ্চরব হবেন, এই আশা থাকল। এ বারের নির্বাচনে, বহু অসুবিধা ও শৃঙ্খলিত বন্দোবস্তের মধ্যেও ভারতীয় জনসমাজ নিজেদের জন্য শাসকের সঙ্গে সঙ্গে এক বিরোধী পক্ষকে নির্বাচন করে এনেছেন। সেই কথা মনে রেখে বিরোধীদের দায়িত্ব পালনের আপাতত-গুরুতম ক্ষেত্রটিই হয়তো এই দণ্ড সংহিতা প্রসঙ্গ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কয়েকটি বিশেষ আশঙ্কাজনক ক্ষেত্র। এত দিনের আইপিসি-র ১২৪-ক ধারাটিতে ‘দেশদ্রোহিতা’ নামক অপরাধটি অর্থে ও ব্যঞ্জনায় ছিল ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারদুষ্ট, তবে তার বদলে এ বারের ন্যায় সংহিতায় ১৫২ ধারাটিতেও কিন্তু প্রায় একই ভাষায় দেশের ‘সার্বভৌমতা ও ঐক্য’র যে কোনও বিরোধিতার ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তিদানের কথা রয়েছে। ‘দেশদ্রোহিতা’ শব্দটিকে উঠিয়ে দিয়ে একই অসহন ও একই কঠোরতা জারি রয়েছে, মনে করা হয়েছে, নাগরিক অত তলিয়ে বুঝবেন না— ও দিকে, সরকার, গত দশ বছরের প্রচলনমতোই, সমালোচনা কিংবা বিরোধিতা যথেচ্ছ নিষ্পেষণ করতে পারবে। অপরাধ এবং সন্ত্রাস দমনে যে নতুন ধারাগুলি যুক্ত হয়েছে, সেগুলিও সরাসরি অধিকারহননের প্রশ্ন তোলে। কিংবা ধরা যাক, গণধর্ষণের শাস্তির কথা। ১৮ বছর বয়সের আগে গণধর্ষিতার যে অধিকার, ১৮ পেরোলেই তার আর সেই অধিকার নেই, অপরাধীদের শাস্তিও অনেক লঘু! বিচিত্র এই ব্যবস্থা, সত্য সেলুকাস! একবিংশ শতকের দ্বিতীয় চতুর্ভাগ থেকে এই পথেই দেশ হাঁটবে কি না, তা দেশের জনপ্রতিনিধিরাই ঠিক করবেন, কিন্তু এই ‘সংহিতা’ চালু করার আগে এমন একটি গুরুতর বিষয়ে নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্য শোনা ও মতামত নেওয়া অবশ্যপ্রয়োজনীয়।