American Physical Society

দাবির প্রতিযোগিতা

১৯৬৯ সালে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক প্রদেশের উডস্টক শহরের কাছে এক গানের উৎসব হয়। অগস্ট মাসের ১৫ থেকে ১৮ তারিখ ওই সম্মেলন যখন হয়, আমেরিকায় তখন বর্ষাকাল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৩ ০৬:৫০
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

আবারও সেই আমেরিকান ফিজ়িক্যাল সোসাইটির মিটিং। ১৯৮৭ সালে যেমন হয়েছিল। পদার্থবিদদের বার্ষিক সম্মেলন। ১৯৮৭ সালের সেই সম্মেলন উডস্টক অব ফিজ়িক্স নামে অভিহিত হয়েছিল। বিশেষণটা, বলা বাহুল্য, ধার করা হয়েছিল উডস্টক মিউজ়িক অ্যান্ড আর্ট ফেস্টিভ্যাল থেকে। ১৯৬৯ সালে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক প্রদেশের উডস্টক শহরের কাছে এক গানের উৎসব হয়। অগস্ট মাসের ১৫ থেকে ১৮ তারিখ ওই সম্মেলন যখন হয়, আমেরিকায় তখন বর্ষাকাল। জল-কাদা উপেক্ষা করে লক্ষ লক্ষ শ্রোতা গান শোনে। আর হিপিদের চরম বিশৃঙ্খলা চার দিকে তুঙ্গে ওঠে। এই রকম বিশৃঙ্খলাই দেখা গেল ১৯৮৭ সালের আমেরিকান ফিজ়িক্যাল সোসাইটির বার্ষিক সম্মেলনে। ওই অধিবেশনে ৫১টি পেপার পড়া হয় হাই-টেম্পারেচার সুপারকন্ডাক্টর নিয়ে। তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য সুইৎজ়ারল্যান্ডে জ়ুরিখ শহরে আইবিএম সেন্টারে কর্মরত পদার্থবিদ কার্ল আলেকজ়ান্ডার মুলার এবং তাঁর সহকারী জোহানেস জর্জ বেদনর্জ। ওঁরা পেপার পড়েন ১৯৮৭ সালের ১৮ মার্চ। আর অক্টোবরে নোবেল প্রাইজ় দেওয়ার সময় এলে, সে বছরই ওঁরা পান সেই পুরস্কার। এমনই গুরুত্বপূর্ণ হাই-টেম্পারেচার সুপারকন্ডাক্টর। অত গুরুত্বপূর্ণ বলেই অত ভিড় হয়েছিল মুলার এবং বেদনর্জের বক্তৃতা শুনতে। ভিড়ের কারণে সম্মেলনের নাম হয় উডস্টক অব ফিজ়িক্স। কেন ওই ভিড়? তা হলে বলতে হয়, সুপারকন্ডাক্টরের কথা। কন্ডাক্টর হল পরিবাহী, যা বিদ্যুৎ পরিবহণ করে। এখন, বিদ্যুৎ পরিবহণ করতে গিয়ে সবটা বিদ্যুৎ পরিবাহী তার বা অন্য কিছু পরিবহণ করে না। রেজিস্ট্যান্স বা রোধের কারণে কিছুটা বিদ্যুৎ নষ্ট হয়। বাধার পরিমাণ এক-এক পদার্থের ক্ষেত্রে এক-এক রকম। সুপারকন্ডাক্টর বা অতিপরিবাহী হল সেই সব পদার্থ, যা প্রায় বিনা বাধায় বিদ্যুৎ পরিবহণ করে। কোনও পরিবাহী পদার্থের উষ্ণতা যদি শূন্য ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের ২৬০-২৭০ ডিগ্রি কমানো যায়, তা হলে সেই পদার্থ অতিপরিবাহী হতে পারে। উষ্ণতা কমাতে আবার খরচ বাড়ে। সে জন্য হাই-টেম্পারেচার সুপারকন্ডাক্টরের খোঁজ, যাতে কম খরচে অতিপরিবাহী তার বা অন্য কিছু তৈরি করা যায়। বিদ্যুৎ পরিবহণ করে, এমন সরঞ্জাম আজকাল সর্বত্র। সুতরাং, খরচ কমানোর দায় এখন সব জায়গায়। এমতাবস্থায় উডস্টক অব ফিজ়িক্সের পরিস্থিতি আবার সৃষ্টি হয়েছিল এই ২০২৩ সালের আমেরিকান ফিজ়িক্যাল সোসাইটির বার্ষিক অধিবেশনে।

Advertisement

খবর ছিল, নিউ ইয়র্কে রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রঙ্গা ডায়াস ওই অধিবেশনে আসতে পারেন। তিনি এমন কিছু ঘোষণা করতে পারেন, যা হাই-টেম্পারেচার গবেষকদের চমকে দেবে। আমেরিকান ফিজ়িক্যাল সোসাইটির ওই অধিবেশনে যথারীতি রঙ্গা আসেন এবং তাঁর পেপার পড়েন। পেপারের দাবি, রঙ্গা এবং তাঁর সহযোগীরা লিউটেশিয়াম ধাতু, নাইট্রোজেন এবং হাইড্রোজেন এমন পদার্থ তৈরি করেছেন, যা ২১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে সুপারকন্ডাক্টর হবে। শ্রীলঙ্কার বিজ্ঞানীর এ-হেন দাবিতে শোরগোল পড়ে যায়। চার দিকে হইচই শুরু হয়ে যায়, তবে কি হাই-টেম্পারেচার সুপারকন্ডাক্টর এত দিনে পাওয়া গেল?

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় প্রচার যে, রঙ্গা এবং তাঁর সহযোগী আশকান সালামত হাই-টেম্পারেচার সুপারকন্ডাক্টর আবিষ্কারের জন্য নোবেল প্রাইজ় পাবেন। মুলার এবং বেদনর্জ ওই প্রাইজ় পেয়েছিলেন একটা উষ্ণতা পর্যন্ত সুপারকন্ডাক্টর তৈরির জন্য। চার পাশের উষ্ণতায় সুপারকন্ডাক্টর তৈরির জন্য নয়। চার পাশের তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টর তৈরি করার সাফল্যের জন্য নোবেল প্রাইজ়, এ আর নতুন কথা কী! পদার্থবিজ্ঞানের দুই বিখ্যাত পত্রিকায় ছাপা হয় ওঁর পেপার। তার পর শুরু হয় পাল্টা প্রচার। রঙ্গা এবং সালামত নাকি অন্য গবেষকদের পেপার থেকে নকল করেছেন। দুই জার্নাল রঙ্গা এবং সালামতের পেপার তুলে নেয়। রঙ্গা বলেছেন, তাঁর চরিত্রহনন করা হচ্ছে। তিনি গিয়েছিলেন আমেরিকান ফিজ়িক্যাল সোসাইটির সম্মেলনে। দক্ষিণ কোরিয়ার দুই গবেষক শুকবে লি এবং জি-হুন কিম আমেরিকান ফিজ়িক্যাল সোসাইটির সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। সোলের ওই দুই বিজ্ঞানী গত ২৫ জুলাই প্রকাশ্য সারভার-এ এক পেপার পোস্ট করেছেন সুপারকন্ডাক্টর নিয়ে। ওঁদের দাবি এখনও পরীক্ষিত নয়, সুতরাং হাই-টেম্পারেচার সুপারকন্ডাক্টর নিয়ে বিজ্ঞানজগৎ এই মুহূর্তেও তোলপাড়। গোটা ঘটনা দেখিয়ে দেয় বিজ্ঞান প্রতিযোগিতা কতখানি তীব্র ও সঙ্কটজনক হতে পারে, দেশকালের সীমা পেরিয়ে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement