রেলের জমি বেদখল হয়ে থাকলে দখলদারদের অপসারণ করে রেল কর্তৃপক্ষ জমির স্বত্ব কার্যকর করতে পারেন বলে সুপ্রিম কোর্ট তা জানিয়েছে। ফাইল ছবি।
পঞ্চাশ হাজার মানুষকে রাতারাতি উৎখাত করা যাবে না। একটি জমিতে দশকের পর দশক ধরে বাস করে আসা মানুষকে আধা-সামরিক বাহিনীর সাহায্যে উঠিয়ে দিতে বলাটা ঠিক নয়— এই বিধান দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি উত্তরাখণ্ড হাই কোর্টের একটি নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ জারি করেছেন। সেই রাজ্যের হলদোয়ানিতে ভারতীয় রেলের একটি জমি থেকে বসবাসকারীদের সরিয়ে জমিটি খালি করার প্রশ্নে হাই কোর্টে দীর্ঘ দিন যাবৎ মামলা চলছিল। সম্প্রতি হাই কোর্ট রায় দেয়, সাত দিনের আগাম বিজ্ঞপ্তি দিয়ে রেল ওই জমি খালি করিয়ে নিতে পারে এবং সে জন্য প্রয়োজনে আধা-সামরিক বাহিনীর সাহায্য নিতে পারে। জমিতে বসবাসকারীদের আসন্ন উচ্ছেদ রোধ করতে দ্রুত ব্যবস্থা করার আর্জি জানিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন করা হয়, আদালত দ্রুত সেই আবেদন বিবেচনা করে স্থগিতাদেশ জারি করেছে, ফলে আপাতত সংশ্লিষ্ট অধিবাসীরা উৎখাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন। তবে, প্রশ্ন কেবল সাময়িক স্বস্তির নয়, উচ্ছেদ বিষয়ে বিচারপতিদের সুস্পষ্ট মন্তব্যটির একটি গভীরতর তাৎপর্য আছে, যা রাষ্ট্রীয় নীতি রচনা ও রূপায়ণের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক।
রেলের জমি বেদখল হয়ে থাকলে দখলদারদের অপসারণ করে রেল কর্তৃপক্ষ জমির স্বত্ব কার্যকর করতে পারেন, এই সহজ সত্যটিকে সুপ্রিম কোর্ট সুস্পষ্ট ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আদালতের প্রশ্ন অপসারণের পদ্ধতি নিয়ে। প্রথমত, যাঁরা রেলের— বা সাধারণ ভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন— জমিতে বাস করছেন, তাঁরা কী ভাবে কোন প্রক্রিয়ায় সেই বসতি তৈরি করেছেন, তা দেখা দরকার। দ্বিতীয়ত, তাঁদের হঠাৎ জোর করে উঠিয়ে দেওয়া ঠিক নয়, গোটা সমস্যার একটা ‘কার্যকর সমাধান’ খুঁজতে হবে। উৎখাত মানুষদের কোনও না কোনও ধরনের পুনর্বাসন সম্ভবত সেই সমাধানের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। তৃতীয়ত, অল্প লোক অল্প কিছু দিন জমি দখল করে থাকলে তা উদ্ধার করা তুলনায় সহজ, কিন্তু বসতি দীর্ঘ দিনের হলে এবং সেখানে বহু মানুষ বসবাস করলে সমস্যাটি সেই অনুপাতেই জটিল। এই তৃতীয় মাত্রাটিই কার্যক্ষেত্রে জটিলতার প্রথম ও প্রধান কারণ।
এখান থেকেই কয়েকটি বিষয় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এক, স্বত্ব বা মালিকানার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরেও ‘স্বাভাবিক ন্যায়’ বা ন্যাচারাল জাস্টিস-এর কারণে সেই অধিকারের প্রয়োগ নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। মানুষের জীবনযাত্রার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কিন্তু সেই ন্যায্যতার অন্যতম প্রধান শর্ত। আচমকা উচ্ছেদের কাজ সেই শর্তটি লঙ্ঘন করে, অতএব জবরদখল অপসারণের অধিকার থাকলেও সর্বদা তার তাৎক্ষণিক ও নিরঙ্কুশ প্রয়োগ করা যায় না। দুই, উচ্ছেদের অধিকারটি কখন কতখানি নিয়ন্ত্রিত হবে, তার কোনও পূর্বনির্ধারিত সূত্র নেই, হতে পারে না। তবে হলদোয়ানির ঘটনা এই ইঙ্গিত দিয়ে যায় যে, বহু মানুষের স্বার্থ বিপন্ন হলে সেই নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়, নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা জোরদার হয়। আর এই কারণেই সরকারি জমিতে যে কোনও রকমের দখলদারি একেবারে গোড়া থেকে প্রতিরোধ করা আবশ্যক। কেননা, প্রধানত সঙ্কীর্ণ রাজনীতির স্বার্থে বহু ক্ষেত্রেই প্রশাসন তথা শাসক দল এই ধরনের বেদখলকে প্রশ্রয় দেয়— শহরের ফুটপাত কিংবা রেলের সম্পত্তি, সব ক্ষেত্রেই সেই প্রশ্রয়ের অজস্র নজির আছে। জানা কথা, এক বার দখলদারি কায়েম হয়ে গেলে তার অপসারণ অসম্ভব রকমের কঠিন হয়ে পড়ে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তটি অতীব গুরুতর। তা এক দিকে পুনর্বাসনের প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এল, অন্য দিকে জানিয়ে দিল— উচ্ছেদের প্রয়োজন যাতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করাই শ্রেষ্ঠ নীতি। এখানেই এই সিদ্ধান্তের সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব।