—প্রতীকী ছবি।
পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বটি কি আদালত কার্যত নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে? ঘটনাক্রম খেয়াল করলে এমন আশঙ্কাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। প্রথমে যা ছিল নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনী ব্যবহারের পরামর্শ, রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অপদার্থতায় তা শেষ অবধি আদেশে পরিণত হল— বাহিনীর সংখ্যাটিও কলকাতা হাই কোর্ট নির্দিষ্ট করে দিল। এ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল কি? রাজ্য প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন যে ভঙ্গিতে চলছে, তাতে স্পষ্ট যে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে তুমুল হিংসা রাজ্যে ঘটছে, তা নিয়ন্ত্রণের কোনও বাসনা প্রশাসন বা কমিশনের নেই। সেই হিংসার পরিবেশে অবাধ নির্বাচন হতে পারে না। অর্থাৎ, প্রশাসন এবং কমিশন তাদের প্রধানতম কর্তব্য— অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আয়োজন— পালনে ব্যর্থ। আদালতের পর্যবেক্ষণ সেই ব্যর্থতার দিকে নির্দেশ করেছে। এই লজ্জা নিবারণের কোনও পথ রাজ্য প্রশাসন বা নির্বাচন কমিশনের নেই— কিন্তু আশঙ্কা হয়, লজ্জা নিবারণের কোনও তাগিদও তাদের নেই। মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে সমগ্র প্রশাসন রাজ্য জুড়ে ঘটে চলা হিংসার ঘটনাগুলিকে অস্বীকার করতে ব্যস্ত। পুলিশ বা প্রশাসনের এই আচরণে অবাক হওয়ার দিন বহু আগেই ফুরিয়েছে— রাজ্যের প্রশাসনের সঙ্গে শাসক দলের ফারাক বজায় রাখার কথাটি আদিগঙ্গার ঘোলা জলে ভেসে গিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাটি তুলনায় নতুন। যথাযথ ভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে হলে কত কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রয়োজন, আদালতের পরামর্শ সত্ত্বেও সেই হিসাব না কষা; তার পর আদালতের আদেশে বাধ্য হয়ে হাস্যকর রকম কম পরিমাণ বাহিনী চাওয়া— কমিশনের ভূমিকা দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, নির্বাচনে শাসক দলের ‘খেলা’টি যাতে নির্বিঘ্নে হতে পারে, তা নিশ্চিত করাই এই প্রতিষ্ঠানের প্রধানতম কর্তব্য।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই পরিস্থিতিতে আদালত যা করেছে, তার কোনও বিকল্প ছিল না। কিন্তু, যে দায়িত্ব রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত, এবং যা সম্পূর্ণতই শাসনবিভাগের কর্তব্য, সেই কাজটিতে বিচারবিভাগের হস্তক্ষেপ এমন অপরিহার্য হয়ে ওঠাও অতি দুর্ভাগ্যজনক। উদ্বেগেরও বটে, কারণ এই ঘটনায় যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হচ্ছে, ভবিষ্যতের পক্ষে তা একটি বিপজ্জনক নজির হয়ে থাকতে পারে। শুধু বিচারবিভাগের হস্তক্ষেপই নয়, ভবিষ্যতে রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত নির্বাচন পরিচালনার কাজটিতে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপও ঘটতে পারে, এমন একটি আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে সেই প্রবণতা বিপজ্জনক। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা বলছে যে, কেন্দ্রীয় সরকার ক্রমেই রাজ্যের অধিকারের গণ্ডিকে সঙ্কীর্ণতর করে তুলতে চায়। এবং, ক্ষমতার সেই ক্রমবর্ধমান অসাম্য ব্যবহৃত হয় সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। নির্বাচন পরিচালনার মতো একটি অধিকার, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে, তাতে যদি কেন্দ্রের (রাজনৈতিক) হস্তক্ষেপের পরিসর তৈরি হয়, তা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে সুসংবাদ হবে না। কিন্তু, অধিকার বস্তুটির সঙ্গে দায়িত্বের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। নির্বাচন পরিচালনার অখণ্ড অধিকার বজায় রাখতে হলে সেই দায়িত্বটিও সম্পূর্ণ শ্রদ্ধার সঙ্গে, যথাযথ ভাবে পালন করা আবশ্যক। পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশন সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে বললে অনৃতভাষণ হবে, তারা দায়িত্ব পালনের চেষ্টাটুকুও করেনি। কোনও নির্বাচন যে রাজনৈতিক হিংসার ছাড়পত্র হতে পারে না, এই কথাটি আদালতকে বলে দিতে হচ্ছে, এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতি যে প্রশাসন নিজেদের জন্য তৈরি করে, তার মুখে কোনও অধিকারের কথাই কি আদৌ মানায়? সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে তাঁরা রাজ্যের, দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের কোন অপূরণীয় ক্ষতি করছেন, রাজ্যের শাসক দলের নেতারা সেটুকুও বুঝলেন না।