সমালোচনা বিফলে যায় নাই। সমালোচিতেরা তৎপর হইয়াছেন। আত্মসংশোধনের জন্য নহে, তাঁহাদের তৎপরতা সমালোচকদের দমন করিতে। সমালোচনা যখন প্রবল এবং প্রবলম্মন্য শাসকের বিরুদ্ধে, তখন বোধ করি এমনটিই হইবার কথা। তাঁহারা সমালোচনা পছন্দ করেন না। তাহা অস্বাভাবিক নহে। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করিবার পরে সমালোচনা পছন্দ করেন, এমন রাজনীতিক অন্তত এই দেশে দুর্লভ। কিন্তু ভারতের বর্তমান শাসক দলের নায়কনায়িকাদের আচরণে নিন্দা-সমালোচনার প্রতি, ভিন্নমতের প্রতি, এমনকি যে কোনও অপ্রিয় প্রশ্নের প্রতি যে তীব্র বিরাগ ও অসহিষ্ণুতা ক্রমাগত প্রকট হয়, তাহাকে এই দেশের মাপকাঠিতেও স্বাভাবিক বলা কঠিন। তাঁহাদের দৃষ্টিতে কেহ সরকারবিরোধী মত প্রকাশ করিলেই দেশদ্রোহী, আরবান নকশাল, সিকুলার, পাকিস্তানে পাঠাইয়া দিবার যোগ্য, ইত্যাদি। অতিমারির মোকাবিলায় বিপুল অপদার্থতা, কুম্ভমেলা হইতে নির্বাচনী সভা অবধি বিবিধ ক্ষেত্রে জনসমাগম নিবারণের পরিবর্তে উৎসাহিত করা, নেতা ও নেত্রীদের মুখে অতিমারিকে তুচ্ছ করিয়া বহুবিধ উৎকট ভাষণ— এই সমস্ত কারণেই সমাজের সচেতন নাগরিকরা তীব্র সমালোচনায় মুখর হইয়াছেন। সমাজমাধ্যমের পরিসরে তাহা প্রবল ভাবে সম্প্রচারিত হইয়াছে। মুক্ত, গণতান্ত্রিক সমাজে ঠিক তেমনটিই হইবার কথা।
কিন্তু ক্ষমতাবানেরা যদি মুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ না চাহেন? কেন্দ্রীয় সরকার সমাজমাধ্যমের পরিচালকদের অনেকগুলি ‘আপত্তিকর’ পোস্ট বা বার্তাগুলি সরাইয়া লইতে বাধ্য করিয়াছে। বার্তাগুলিতে নাকি মিথ্যা খবরে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করিয়া কোভিডের মোকাবিলায় বাধা সৃষ্টির আশঙ্কা ছিল! যাঁহাদের মন্তব্য সরানো হইয়াছে, তাঁহাদের মধ্যে আছেন বিরোধী দলের প্রবীণ নেতা, সাংসদ হইতে শুরু করিয়া রাজ্য সরকারের মন্ত্রী। সব ‘আপত্তিকর’ বার্তাই সরকারের সমালোচনায় মুখর। আপত্তির প্রকৃত কারণটি অনুমান করা কঠিন নহে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মহতো মহীয়ান, তিনি হুমকি দিয়াছেন— অতিমারি বিষয়ে কেহ সমাজমাধ্যমে বা অন্যত্র ‘গুজব’ রটাইয়া ‘পরিবেশ নষ্ট’ করিতে প্রবৃত্ত হইলে তাহার বিরুদ্ধে সুকঠোর জাতীয় নিরাপত্তা আইন মোতাবেক ব্যবস্থা করা হইবে, এমনকি তাহার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইবে। যোগীবরের রায়: তাঁহার রাজ্যে নাকি অতিমারির মোকাবিলায় কোনও ত্রুটি নাই, কোনও অভাব নাই, অভাব নাই এমনকি অক্সিজেনেরও। ‘পোস্ট-ট্রুথ’-এর তাত্ত্বিকরাও তাঁহাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিবেন।
কানাডার প্রসিদ্ধ লেখক ও সমাজকর্মী নাওমি ক্লাইন মন্তব্য করিয়াছেন, ভারতে বিরুদ্ধ-মত দমনের এই তৎপরতা ভীতিপ্রদ হইলেও বিস্ময়কর নহে। কথাটি ঠিকই, তবু বলিতেই হয়— কিছু বিস্ময় রহিয়া গেল। স্বাভাবিক অবস্থায় যে শাসকরা সমস্ত বিষয়ে সমস্ত সংবাদেই আপন বন্দনা শুনিতে আগ্রহী, এমন ভয়ঙ্কর বিপদের দিনে এবং নিজেদের চূড়ান্ত ব্যর্থতার মধ্যে তাঁহারা কিছুটা সংযত হইতে পারিতেন, ব্যর্থতার আট আনা না হউক চার
আনা স্বীকার করিয়া সমালোচকদের অন্তত ব্যাজস্তুতি করিতে পারিতেন, তাহাতে শেষ অবধি ভাবমূর্তিরও কিঞ্চিৎ সংস্কার হইত। কিন্তু তাঁহারা এক আনা ছাড়িতেও রাজি নহেন। প্রলয়ের মধ্যে দাঁড়াইয়াও শাসকরা প্রচারের কৌশলে নিজেদের ভাবমূর্তি পালিশ করিতে চাহিতেছেন এবং কেহ তাহাতে বাদ সাধিলে ক্ষিপ্ত হইতেছেন— দেখিবার মতো ব্যাপার বটে। তবে কিনা, এই বিশ্বায়িত প্রচারের দুনিয়ায় পালিশ টিকিবে কি? আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলিতে তাঁহাদের সম্পর্কে কী লেখা হইতেছে, কী ভাষায় লেখা হইতেছে, নরেন্দ্র মোদী নিশ্চয়ই তাহা জানেন। রক্তচক্ষু দেখাইয়া এই বিপর্যয়কে আড়াল করা অসম্ভব। তাহা টের পাইয়াছেন বলিয়াই কি এত রাগারাগি, এত দাপাদাপি?