রোগী ধর্মে মুসলমান। সেই কারণেই তাঁহার শুশ্রূষার জন্য সেবিকা পাঠানো যাইবে না। এহেন গুরুতর অভিযোগটি উঠিয়াছে মালদহের এক সেবিকা সংযোগ সংস্থার বিরুদ্ধে। পরিবারের দাবি, রোগীর নাম জানিবার পরই তাঁহাদের বলা হয়, মুসলমান হইলে সেবিকারা যাইতে চাহেন না। স্বাভাবিক ভাবেই অসহায় পরিবারটি প্রশ্ন তুলিয়াছে, অসুস্থকে পরিষেবা দিবার ক্ষেত্রেও কি তাঁহার জাত, ধর্ম অগ্রাধিকার পাইবে? এই প্রশ্ন হইতে বৃহত্তর এক প্রশ্ন উঠিয়া আসিতেছে— এই চরম দুঃসময়ে, যখন সব ভুলিয়া ‘মানুষ’ হইয়া মানুষের পার্শ্বে দাঁড়াইবার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, তখনও কি এক শ্রেণির মানুষ সেই পরিচয়-সর্বস্ব সঙ্কীর্ণতার মধ্যেই আবদ্ধ থাকিবে?
সত্য যে, বিপদ যখন শিয়রে তখন সব ভুলিয়া তাহার মোকাবিলার কাজে ঝাঁপাইয়া পড়াই মানবিক ধর্ম। মানুষ তাহা করেও। কিন্তু শুধুমাত্র তাহাতে ভরসা করিয়া নিশ্চিন্ত থাকা চলে না। কেন চলে না, তাহার কারণ মনুষ্যচরিত্রে নিহিত আছে। বিপদের মুহূর্তে আত্মবিস্মৃত হইয়া, পুরাতন বিবাদ-বিসম্বাদের পুঁটুলি সরাইয়া মানুষ যেমন অন্যের সাহায্যে ঝাঁপাইয়া পড়িতে পারে, তেমনই আবার স্ব-ভাব অনেককে পিছে টানিয়া রাখে। বাঙালি যতই নিজেকে পরিশীলিত, উদার, যুক্তিবাদী, ধর্ম-জাত নিরপেক্ষ বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করুক, বাস্তবে বহু মানুষই এখনও সমস্ত সঙ্কীর্ণতা ঝাড়িয়া ফেলিতে পারেন নাই। খাস কলিকাতা শহরেও মুসলমানদের বাড়ি ভাড়া পাইতে বিস্তর ঝামেলা ভোগ করিতে হয়। অতিমারি পরিস্থিতিও সেই প্রবণতায় বিশেষ পরিবর্তন আনিতে পারে নাই। বরং ক্ষেত্রবিশেষে আরও প্রকট হইয়াছে বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। জাতপাত বিষয়েও একই কথা। করোনাকালে আক্রান্ত পরিবারের দরজায় খাবার সরবরাহ করিবার ভার তুলিয়া লইয়াছে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। আক্রান্ত পরিবার তাহাদের কাছে সর্বাগ্রে খোঁজ করিয়াছে রন্ধনকারী ব্রাহ্মণ কি না, এমন উদাহরণও আছে। শুধু জাতি বা ধর্মের বিভাজিকাই নহে, এই বিপন্ন সময়ে মানুষ বিভিন্ন অক্ষে ‘অপর’ নির্ধারণ করিয়াছেন, এবং তাহাদের প্রতি আচরণে কারুণ্যের লেশমাত্র প্রদর্শন করেন নাই। প্রিয়জনের মৃতদেহ লইয়া বসিয়া আছেন অসহায় নাগরিক, সাহায্যের একটি হাতও কেহ বাড়াইয়া দেয় নাই। কোনও ক্ষেত্রে সন্তানই ত্যাগ করিয়াছে অসুস্থ বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে। সব অতি-সঙ্কটই সমাজের এই ভয়ঙ্কর চেহারাটিকে নগ্ন করিয়া দেয়।
তবে, তাহাই একমাত্র সত্য নহে। এই অতিমারি-বিধ্বস্ত সময়ে যে মানুষগুলির নিঃস্বার্থ পরহিতৈষণায় বহু আর্তজন প্রাণে বাঁচিয়াছেন, তাঁহারাও এই সমাজেরই অংশ। প্রশ্ন হইল, বঙ্গবাসী কোন পরিচিতিটিকে আঁকড়াইয়া ধরিবে? প্রবৃত্তি-তাড়িত স্বার্থপরতা, না কি চেতনা-প্রসূত সহমর্মিতা, কোন পরিচয়টি এই সমাজের অভিজ্ঞান হইবে? এই প্রশ্নটির উত্তর কিন্তু বহুলাংশে সন্ধানপ্রক্রিয়া হইতেই নির্মিত হয়। যদি স্বার্থপরতা, হীনতাগুলিকে দ্ব্যর্থহীন ধিক্কার জানানো হয়, যদি সহমর্মিতার উদাহরণগুলিকে সশ্রদ্ধ স্বাগত জানানো হয়, তবে সমাজও সেই সঙ্কেত পড়িয়া লইতে ভুল করিবে না। যে আচরণ কাম্য, তাহার আদর করিতে জানা প্রয়োজন। এই পথেই সমাজ নির্মিত হয়।