এক মণ্ডপ থেকে অন্য মণ্ডপে হেঁটে চলেছে অনিঃশেষ ভিড়। —ফাইল চিত্র।
রাস্তায় জনস্রোত বইছে। এক মণ্ডপ থেকে অন্য মণ্ডপে, রোলের দোকান থেকে বিরিয়ানির স্টলে হেঁটে চলেছে অনিঃশেষ ভিড়। সেই প্রবহমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে যদি যে কোনও এক জনকে বেছে নিয়ে প্রশ্ন করা যায় যে, এই ভিড় সম্বন্ধে এই মুহূর্তে তাঁর মনোভাব ঠিক কী, সপ্রশংস উৎফুল্ল উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। অনুমান করা চলে, সেই যদৃচ্ছ ভাবে নির্বাচিত ব্যক্তিটি বলবেন, এই ভিড় অসহনীয়। কেউ পা মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে তো কেউ কনুইয়ের গুঁতোয় পাঁজরের হাড় ভেঙে দেওয়ার উপক্রম করছে। কারও বিন্দুমাত্র ধৈর্য নেই, কেউ আবার অন্যকে টপকে লাইনের আগে পৌঁছে যাওয়ার জন্য ন্যায়-অন্যায়ের ধার ধারছে না। মোট কথা, এই ভিড়কে পছন্দ করার কোনও কারণ তাঁর নেই। ধরা যাক, ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর সামনে আবির্ভূত হল প্রদীপের দৈত্য— তবে তার একটি বিশেষ ক্ষমতা আছে, তার কাছে প্রভুকে মনোবাসনা ব্যক্ত করতে হয় না, সে মনের কথা বুঝে নিতে পারে। দৈত্য সেই যদৃচ্ছ ভাবে নির্বাচিত ব্যক্তিকে আভূমি কুর্নিশ করে বলল, জো হুকুম জাহাঁপনা; এবং, মুহূর্তের মধ্যে সব ভিড় উধাও হয়ে গেল। পড়ে রইল আলোকিত মণ্ডপ, মাইকে ভেসে আসা ‘আগত দর্শনার্থীবৃন্দ’-র উদ্দেশে স্বাগত ভাষণ, রোল-বিরিয়ানির দোকান— কিন্তু একটি বই মানুষ রইল না গোটা শহরে। অনুমান নয়, একেবারে নিশ্চিত ভাবে বলা চলে, এত ক্ষণ যিনি ভিড়ে নাজেহাল হচ্ছিলেন, সম্পূর্ণ নির্জন পুজোর শহর তাঁকে গিলে খেতে আসবে। উধাও হয়ে যাবে প্রতিমা দর্শনের যাবতীয় আনন্দ। ভিড়ের জন্য তাঁর প্রাণ আকুলিবিকুলি করবে। দৈত্য যদি প্রভুর মনের কথা বুঝে ভিড় ফিরিয়ে দেয়, তা হলে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পাশের জনের পা মাড়িয়ে এগিয়ে যাবেন পরের প্যান্ডেলের দিকে।
পুজোর ভিড়ের চরিত্র এমনই— অসহ্য, বিরক্তিকর, কিন্তু অত্যাগসহন। কারণটি সহজ— কোনও সর্বজনীন বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট আনন্দ হচ্ছে কি না, সেটা বোঝার কোনও অন্তর্গত ব্যবস্থাপনা আমাদের মগজে নেই। আমরা আনন্দ মাপি অন্যের আনন্দের দাঁড়িপাল্লায়। যাতে আর পাঁচ জনের আনন্দ হয়, তাতে আমাদেরও আনন্দ হচ্ছে, এই বিশ্বাসটিই মানুষকে বহু জিনিস উপভোগ করতে শেখায়। অর্থশাস্ত্রের দুনিয়ায় এর নাম ‘ব্যান্ডওয়াগন এফেক্ট’। অনেকে উপভোগ করছে বলেই কোনও একটি বিষয় উপভোগ্য হয়ে উঠছে। এই প্রবণতাটির বহু উদাহরণ রয়েছে ফ্যাশন থেকে আর্থিক বাজার, সর্বত্র। তার একটা ভিন্নতর উদাহরণ মিলতে পারে খেলার দুনিয়ায়। এ বারে বহু লোক টেলিভিশনে বা অ্যাপে এশিয়ান গেমস-এর খেলা দেখলেন— এমন সব খেলা, দশ বছর আগেও অনেকেই যার অস্তিত্ব সম্বন্ধেই সচেতন ছিলেন না। ভারতীয় খেলোয়াড়রা ইদানীং এই সব খেলায় সফল হচ্ছেন, তা এই বর্ধিত আগ্রহের একটি কারণ, কিন্তু সম্ভবত মুখ্য কারণ নয়। অনেকে এই খেলায় আগ্রহী হয়েছেন, তাই অনেকে আগ্রহী হচ্ছেন— সবার যখন ভাল লাগছে, তখন নিশ্চয়ই ভাল লাগার কারণ আছে।
তবে, অনেকেই খেলা দেখছে বলে নিজের বৈঠকখানায় বসে টিভিতে খেলা দেখা আর শহরের রাস্তায় জনস্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া, দুটো এক কথা নয়। সত্যিই বিভিন্ন জনপ্রিয় পুজোর প্যান্ডেলে যে পরিমাণ ভিড় হয়, রাস্তাঘাটে যতখানি যানজট ঠেলতে হয়, শারীরিক ভাবে তা সহ্য করা বেশ কঠিন। এ ক্ষেত্রে কেউ ভাবতে পারেন, ভিড়ের কি কোনও ‘অপ্টিমাম’ পরিমাণ হয়— অর্থাৎ, সেই পরিমাণ ভিড় যতখানি আনন্দ দেবে, তার কম বা বেশি ভিড়ে আনন্দের পরিমাণ তার তুলনায় কম হবে? বিভিন্ন পুজোর শৈল্পিক বা অন্য গুণাবলির মধ্যে যদি বৈষম্য কমে, যদি অনেকগুলি পুজো কাছাকাছি মানের হয়ে ওঠে, তা হলে কি প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে ভিড়ের বণ্টন তুলনায় সুষম হবে? তাতে ‘অপ্টিমাম’ ভিড়ের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব হবে?