পশ্চিমবঙ্গ বাস্তবিকই একটি দুঃস্বপ্নের বছর কাটিয়ে এল। প্রতীকী ছবি।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ জন্মোৎসব উপলক্ষে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণের উপসংহারে ব্রিটিশ রাজের দুঃশাসনে বিপর্যস্ত ভারতবর্ষের করুণ অবস্থার কথা লিখেছিলেন এক গভীর মর্মস্পর্শী বেদনার ভাষায়। দেশের ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে, ‘লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আবর্জনা’ নিয়ে ‘এ কী বিস্তীর্ণ পঙ্কশয্যা দুর্বিষহ নিষ্ফলতাকে বহন করতে থাকবে’— সেই ভাবনা তাঁকে তীব্র ভাবে বিচলিত করেছিল। নতুন বছরের সূচনায় পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে গিয়ে সচেতন নাগরিক যদি ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধের সেই শেষ কথাগুলি স্মরণ করেন, বিস্ময়ের কারণ থাকবে কি? বঙ্গসমাজ যে বছরটি সদ্য অতিক্রম করে এসেছে তার দিকে ফিরে তাকালে যে দীনতার আবর্জনা বিপুল আকারে দৃশ্যমান হয়, যে পঙ্কশয্যা দৃষ্টিপথে আদিগন্ত বিস্তীর্ণ হয়ে থাকে, তা কেবল লজ্জা দেয় না, আতঙ্কিত করে। কার্যত সারা বছর ধরে দিনের পর দিন একটি রাজ্যে সংবাদের শিরোনামে দেখা গিয়েছে দুর্নীতি আর পাচার আর গুন্ডামির রকমারি বিবরণ, সেই সব অনাচারের তদন্ত এবং বিচারের কাহিনি। ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির বহর দেখে বিচারপতিরা বারংবার তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছেন, সেই ক্ষোভের সঙ্গে মিশে-থাকা বিপুল বিস্ময়ের সুরটিও অনেক সময়েই অতি স্পষ্ট ছিল। অনাচার কোথায় পৌঁছতে পারে, তা উপলব্ধি করেই বোধ করি এই বিপন্ন বিস্ময়। পশ্চিমবঙ্গ বাস্তবিকই একটি দুঃস্বপ্নের বছর কাটিয়ে এল।
নতুন বছরে এই রাজ্যের মানুষ কি অন্য রকম স্বপ্ন দেখার সুযোগ পাবেন? পশ্চিমবঙ্গের শাসনভার যাঁদের হাতে, তাঁরা কি আদৌ তেমন কোনও সম্ভাবনা তৈরি করতে চান? চাইলে, তাঁদের প্রথম এবং প্রধান করণীয় একটিই। প্রশাসন ও জনজীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে যে ক্লেদ জমেছে, তাকে দূর করে একটি সুস্থ পরিবেশ এবং পরিচ্ছন্ন শাসনকাঠামো ফিরিয়ে আনা। গত কিছু দিন ধরে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থাটিতে যে সংস্কারের কিছু উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে, নতুন নিয়োগের যে আয়োজন শুরু হয়েছে, সেটি এই সামগ্রিক শুদ্ধির একটি অত্যন্ত জরুরি অঙ্গ, কিন্তু তার পরিধি নিতান্ত সীমিত। এই সংস্কারকে সমস্ত পরিসরে সর্বস্তরে প্রসারিত করা দরকার, এবং অবিলম্বে। তবেই পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দেশে ও দুনিয়ায় যে বিপুল অনাস্থা তৈরি হয়েছে তা ক্রমে কাটতে পারে। এই রাজ্য যে গভীর অন্ধকার থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সেটা তাকেই প্রমাণ করতে হবে। তার দায় সর্বাগ্রে শাসকদেরই।
সেই দায় তাঁরা মেটাবেন, এমন ভরসা অবশ্য সুদূরপরাহত। আদালতের প্রবল তাড়নায় যেটুকু করতে হচ্ছে তার বেশি কোনও সদিচ্ছার প্রমাণ আজও, এত কাণ্ডের পরেও, মেলেনি। বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় মাতব্বরদের দাপট অব্যাহত। প্রতিবাদ বিক্ষোভের উপর চড়াও হয়ে বিরোধী-দমনের পালা চলছে, শারদীয় উৎসবের মরসুমে ভিন্নমতের বইয়ের বিপণিতে ভাঙচুরের কাহিনিকে মনে পড়িয়ে দিয়েছে বর্ষশেষে ভিন্নমতের নাট্যকর্মীদের মারধরের সাম্প্রতিক ঘটনা। অদূরবর্তী পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই নানা অঞ্চলে শাসক দলের নানা মাপের নেতাদের মুখে হুমকি শোনা যাচ্ছে। ছাত্র সংগঠনে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচনের রুদ্ধদ্বার খোলার কোনও সম্ভাবনা নেই, চিকিৎসকদের সংগঠনে নির্বাচনের নামে প্রদর্শিত হয়েছে নতুন কুনাট্য। তার পাশাপাশি অতিমারিতে বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থার, বিশেষত স্কুলশিক্ষার হাল ফেরানোর সামান্যতম উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না, উপরন্তু শিক্ষকের অভাবে গ্রামাঞ্চলের বহু সরকারি স্কুলের নাভিশ্বাস উঠেছে। শাসক শিবিরের নায়ক-নায়িকারা চলচ্চিত্র উৎসব থেকে কেক উৎসব অবধি রকমারি তামাশার আয়োজনে ব্যস্ত, আধিকারিকরা নায়ক-নায়িকাদের আদেশ পালনে সতত তটস্থ। পশ্চিমবঙ্গ নামক প্রমোদতরণী চলছে, চলবে।