কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
একশো আশি ডিগ্রি ঘুরতে পারে রাজনীতির কৌশল— কিন্তু রাজনীতিকে স্থির, অবিচল রেখেই। কেন্দ্রীয় বিজেপি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আবারও দেখিয়ে দিলেন, কী ভাবে তাঁর ও তাঁদের অভীষ্ট সাধনের জন্য প্রয়োজনে তাঁরা ব্যাক গিয়ারে নিয়ে উঁচু গিয়ারে তুলতে পারেন। কিছু দিন আগেও তাঁদের মুখে এক দেশ এক শিক্ষা এবং এক দেশ এক ভাষার লব্জ শোনা যাচ্ছিল, এখন অকস্মাৎ শোনা যাচ্ছে ‘আঞ্চলিক ভাষা’র জয়গান। আঞ্চলিক ভাষার পথটি স্বীকার করে নিলেও হিন্দির আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় যে অসুবিধা হবে না, তা তাঁরা বিলক্ষণ জানেন। বাস্তবিক, এক পাশে আঞ্চলিক ভাষার জয়গান গাইতে গাইতেই অন্য পাশ ফিরে শ্রীযুক্ত শাহ হিন্দিতে ডাক্তারি পাঠ্যক্রমের বইপত্রের প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রকাশটি সেরে ফেলেছেন। মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ ইত্যাদি উচ্চারিত ঘোষণার পাশেই অনুচ্চারিত হিন্দি-অধ্যুষিত শিক্ষাসংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার বন্দোবস্ত চলছে। প্রশ্ন হল, এই ধোঁকার বন্দোবস্তটি আদৌ দরকার হল কেন? দরকার হল কেননা, জাতীয় শিক্ষা নীতি এবং তার পরোক্ষ আচ্ছাদনে এক দেশ এক ভাষা নীতি প্রকাশমাত্রেই দক্ষিণ ভারতের কিছু রাজ্য বিষম গোলযোগ শুরু করেছে। বিশেষত তামিলনাড়ু ও কেরল। এ দিকে কর্নাটক দখলের পর এখন বিজেপি তেলঙ্গানা জয়ে বেরিয়ে পড়েছে— দক্ষিণ ভারতকেও তার তুষ্ট রাখা চাই। তামিলনাড়ু এবং কেরল ছাড়া আর কোথাও তেমন প্রতিরোধের সম্মুখীন হবেন না তাঁরা, এ কথা তাঁরা জানেন। তাই আঞ্চলিক ভাষার ফুলবেলপাতাটুকু ছুঁইয়ে রাখলে হিন্দি আরাধনা গোটা দেশেই চালু করে দেওয়া সম্ভব— এটাই ‘শাহি হিসাব’।
এবং এই হিসাবের পাখির চোখ— অবশ্যই ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন। উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তৃত বলয়ে হিন্দিভাষী মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত শহুরে, মফস্সলি ও গ্রামীণ মানুষ যে এর মধ্যে নিজেদের ‘মঙ্গল’, এমনকি ‘জয়’ দেখবেন, বুঝতে অসুবিধা হয় না। অনেকেরই মতে, ইংরেজিশিক্ষিত ‘এলিট’দের কুক্ষিগত ক্ষমতার কারণেই তাঁরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে আছেন, ইংরেজি সরলেই অগ্রগতির বাধা সরবে। এই মানসাঙ্ক ভিত্তিহীন নয়, কিন্তু সর্বত সত্য নয়— বহু রাজ্যেই ইংরেজির পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষায় পড়াশোনা ও কাজকর্মের পরিসর গত কয়েক দশক ধরে তৈরি হয়েছে। বিপরীতে, মনে রাখা দরকার, উচ্চশিক্ষা, বিশেষত পেশাভিত্তিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজি কিন্তু এখনও বিশ্বমানের কাজকর্মের সঙ্গে ভারতীয় সমাজকে যুক্ত করে থাকে। দেশের মধ্যেও নিজ রাজ্যের বাইরে অন্যত্র অভিবাসন ও কর্মের সুযোগ তৈরিতে ইংরেজি বড় সহায়ক হতে পারে। ফলে, এক দিক দিয়ে যেমন ইংরেজি-বিরোধিতা ক্ষমতায়নের পথ তৈরি করে, অন্য দিকে ক্ষমতায়নের অন্য একটি পথ রোধ করে দাঁড়ায়।
শ্রীযুক্ত শাহ সম্ভবত এত জটিল ভাবনা ভাবছেন না। তাঁর কাছে রাজনীতির হিসাবটিই চূড়ান্ত। এবং হিন্দু হিন্দি হিন্দুস্থানের রূপায়ণ-লক্ষ্যে হিন্দিপ্রসারের যথাসম্ভব ব্যবস্থা করাই মোক্ষ। তবে কিনা, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের এতে ক্ষতি না লাভ, তা পশ্চিমবঙ্গবাসীকেই স্থির করতে হবে। আঞ্চলিক ভাষার যে জানলাটি খোলা রাখা হয়েছে, তাকে যথার্থ ভাবে ব্যবহার করতে পারলে বাংলাভাষী মানুষের কাছে বাংলা তার হৃত মর্যাদার কিছুটা ফিরে পেতে পারে। কিন্তু সাধারণ ভাবে বাংলা ভাষার প্রতি যে অসীম অবহেলা ও অবজ্ঞা বাঙালি দেখিয়ে আসেন, তাতে অনুমান করা যায়, এই জানলাটি বন্ধই থেকে যাবে, এবং সেই পথে বর্তমানের মতোই হিন্দির সুড়ঙ্গ খনন চলবে, তার আকারপ্রকার বিস্তার পাবে। আঞ্চলিক ভাষা তত জোরদার নয়, তাই হিন্দি ছাড়া গতি কী— এই গুপ্ত শাহি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে পশ্চিমবঙ্গ সক্রিয় সহায়তাই করবে, এ সম্ভাবনা যথেষ্টই।