বেঙ্গালুরুতে বিরোধী বৈঠক। ছবি: পিটিআই।
মঙ্গলবার বেঙ্গালুরুতে নবজাত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়ান্স বা ভারতীয় জাতীয় উন্নয়নী সর্বজনীন মোর্চার ভবিষ্যৎ কী, ২৬টি রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের সম্মেলনে ঘোষিত যৌথ সঙ্কল্প শেষ অবধি কত দূর চরিতার্থ হবে, তার উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত। শ্রাবণস্য প্রথম দিবসে ভূমিষ্ঠ ‘ইন্ডিয়া’-র অভিভাবক ও হিতৈষীরা আপাতত কেবল প্রার্থনা জানাতে পারেন: কালে বর্ষতু পর্জন্যঃ। কিন্তু এই ঘটনাটি নিজেই জাতীয় রাজনীতির পরিসরে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত রচনা করেছে। তার প্রথম কারণ অবশ্যই নামকরণের নাটকীয় বুদ্ধিমত্তা, মতান্তরে চতুরতা। ‘ইন্ডিয়া’ নামটির মধ্য দিয়ে কেবল বিরোধী ঐক্যের এক সম্ভাবনাময় পরিচিতি নির্মাণের অবকাশ তৈরি হয়নি, ওই শিরোনামের অন্দরমহলেই স্থান করে নিয়েছে উন্নয়নের লক্ষ্য এবং সবাইকে নিয়ে চলার আকাঙ্ক্ষা। ফলিত রাজনীতির অনুশীলনে ‘রেটরিক’ বা বাক্শৈলীর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কার্যত আক্ষরিক অর্থে রাতারাতি ‘এনডিএ’ বৈঠকের আয়োজন করে এবং ২৬-এর জবাবে ৩৮টি দলকে সেখানে হাজির করে কেন্দ্রের শাসকরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা ‘ইন্ডিয়া’ নিয়ে চিন্তিত। তাঁদের এই প্রতিক্রিয়াই— নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে— বিরোধী রাজনীতির সক্রিয়তার তাৎপর্য জানিয়ে দিচ্ছে।
সম্ভাবনার সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে আছে বিরোধী জোটের সমস্যা। বিভিন্ন স্বার্থের টানাপড়েন সামলে একটি কার্যকর সমন্বয় গড়ে তোলার এবং টিকিয়ে রাখার কাজটিকে কঠিন বললে কম বলা হয়। সেই টানাপড়েন অনেক ক্ষেত্রেই সরাসরি দ্বন্দ্ব-সংঘাতের রূপ ধারণ করবে, সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে রাজ্য রাজনীতির বৈপরীত্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস এবং বামপন্থী দলগুলির সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের তীব্র বিরোধের এই মরসুমে বেঙ্গালুরুর ঐক্যপ্রয়াস নিয়ে এই রাজ্যের রাজনীতিতে জল ঘোলা হয়েছে। বিজেপির নেতানেত্রীরা প্রত্যাশিত ভাবেই সেই জল আরও ঘোলা করে মাছ ধরতে তৎপর হয়েছেন, কেবল রাজ্য স্তরে নয়, জাতীয় স্তরে, এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অবধি সেই উদ্যোগে শামিল। বিরোধী শিবিরের অন্দরে এমন অনেক দ্বন্দ্ব আছে এবং থাকবে। কোনও ইন্ডিয়ার নাম জপ করে সেগুলিকে তাড়ানো যাবে না।
এই দ্বন্দ্বময় বাস্তবই সমন্বয়ের প্রয়োজন এবং তার সম্ভাবনাকে এক ভিন্ন মাত্রা দেয়। মনে রাখতে হবে, ভারত নামক দেশটির সমাজ ও সংস্কৃতি মর্মে মর্মে দ্বন্দ্বময়। এই দেশের রাজনীতি সেই বহুমাত্রিক স্বার্থসংঘাতের ধারক ও বাহক। বিভিন্ন দল বা গোষ্ঠীর পারস্পরিক সমন্বয় তাই নিছক নির্বাচনী পাটিগণিতের যোগবিয়োগ নয়, পারস্পরিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতি নির্মাণের প্রশ্ন। বর্তমান শাসকরা সেই উদার গণতন্ত্রের মৌলিক শর্তটিকেই ক্রমাগত অস্বীকার এবং লঙ্ঘন করে এক সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদ কায়েম করতে তৎপর। বিরোধী রাজনীতি যদি তার যথার্থ প্রতিস্পর্ধী বিকল্প রচনা করতে পারে, তবেই তার বিরোধী-সত্তা ভোটের অঙ্ক ছাড়িয়ে গণতন্ত্রের বৃহত্তর পরিসরে সার্থক হবে। আঞ্চলিক স্তরে বিরোধী দলগুলির স্বার্থের মধ্যে বিস্তর দূরত্ব আছে, বৈপরীত্যও। কিন্তু সেই বৈপরীত্যের কারণেই এই বিকল্পের সন্ধান তথা অনুশীলন জরুরি। এই অনুশীলনের মধ্য দিয়েই ভারতীয় রাজনীতি এক নতুন পরিণতি অর্জন করতে পারে, উন্নীত হতে পারে এক ভিন্ন স্তরে, যেখানে কেন্দ্র এবং রাজ্য রাজনীতির স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই গণতন্ত্রের পথে চলা যায়। তার দায় সমস্ত দলকেই স্বীকার করতে হবে, রাজ্য স্তরেও সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদের পথ ছেড়ে গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতার চর্চা শিখতে হবে। অত্যন্ত কঠিন কাজ, পারস্পরিক দূরত্ব সরিয়ে রেখে নৈশভোজের আসরে ‘ইন্ডিয়া’ আবিষ্কারের থেকে অনেক বেশি কঠিন। সেখানেই ভারতীয় গণতন্ত্রের পরীক্ষা।