নক্ষত্রে প্রচণ্ড চাপে ও তাপে যে ফিউশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তা পৃথিবীতে করা কঠিন। প্রতীকী ছবি।
আমেরিকায় এক গবেষণাগারে চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু জুড়ে ফিউশন প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হল একটা হিলিয়াম পরমাণু। এই প্রক্রিয়ায় কিছুটা ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। নক্ষত্র থেকে হাইড্রোজেন বোমা, সবেরই শক্তির উৎস ফিউশন প্রক্রিয়া। পরমাণু বোমায় চলে ফিশন প্রক্রিয়া, যাতে ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়ামের মতো ভারী পরমাণু বিভাজিত হয়ে হালকা পরমাণু তৈরি করে। এ ক্ষেত্রে নক্ষত্রের সঙ্গে তুলনা চলে পরমাণুচুল্লির।
নোবেলজয়ী পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান একদা বলেছিলেন, পৃথিবী ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে, শুধু এই জ্ঞানটুকু সম্বল করে মানুষ কাজ চালিয়ে নিতে পারবে যে, সব কিছু পরমাণু দিয়ে গড়া, এবং পরমাণুরা একে অন্যকে আকর্ষণ করে, কিন্তু খুব কাছাকাছি হলে বিকর্ষণ করে। নক্ষত্রে যে ফিউশন প্রক্রিয়া চলে, তা প্রায় ৭০ বছর আগে জানা ছিল। পৃথিবীর শক্তির চাহিদা মেটাতে পরমাণুচুল্লিতে ফিশন প্রক্রিয়ার অতিরিক্ত ফিউশন প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদনে বিজ্ঞানীরা আগ্রহী। কিন্তু চারটে হাইড্রোজেন পরমাণু নিষ্পেষণ করে একটা হিলিয়াম পরমাণু সৃষ্টি করাতে পারমাণবিক বিকর্ষণের কারণে অসুবিধা। সেই অসুবিধা অতিক্রম করে ফিউশন প্রক্রিয়া চালু রাখা কঠিন কাজ। চারটে হাইড্রোজেন পরমাণু নিষ্পেষণ করতে যে পরিমাণ শক্তি খরচ হয়, ফিউশন প্রক্রিয়ায় এত দিন পর্যন্ত শক্তি পাওয়া যাচ্ছিল তার চেয়ে কম। এই প্রথম চারটে হাইড্রোজেন পরমাণুকে নিষ্পেষিত করতে কম শক্তি খরচ হল। এ সাফল্য কম কিসে? নক্ষত্রে প্রচণ্ড চাপে ও তাপে যে ফিউশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তা পৃথিবীতে করা কঠিন। সে জন্য বহু দেশে ল্যাবরেটরিগুলোতে ইগনিশন সম্ভব হয়নি। কম ঝুঁকির ও দূষণমুক্ত শক্তির জন্য ফিউশনের চাহিদা এত বেশি। কিন্তু, তা সব সময়েই ‘তিন দশক পরের ব্যাপার’ হয়ে থেকেছে।
সে জন্য ১৯৮৯ সালে আমেরিকায় এক খবর নিয়ে খুব হইচই হয়। দুই রসায়নবিদ মার্টিন ফ্লেশম্যান এবং স্ট্যানলি পনস এক প্রেস কনফারেন্স ডেকে ঘোষণা করেন, তাঁরা টেস্ট টিউবে ভারী জলের মধ্যে ফিউশন আবিষ্কার করেছেন। সাধারণ জলে থাকে দুই পরমাণু হাইড্রোজেন ও এক পরমাণু অক্সিজেন। এখন, সাধারণ হাইড্রোজেন পরমাণুতে থাকে একটা প্রোটন ও একটা ইলেকট্রন। কোনও কোনও হাইড্রোজেন পরমাণুতে একটা প্রোটনের সঙ্গে একটা নিউট্রনও থাকে। এ রকম হাইড্রোজেন পরমাণুকে বলে ডয়টেরিয়াম। বাড়তি একটা নিউট্রন থাকায় ডয়টেরিয়াম ভারী হয়। যে জলে দুটো পরমাণু হাইড্রোজেনের বদলে দুটো পরমাণু ডয়টেরিয়াম থাকে, সে জল স্বভাবতই ভারী হয়। যে কাজ পদার্থবিজ্ঞানীরা দশকের পর দশক ধরে করতে পারছেন না, তা দুই রসায়নবিদ করে ফেললেন নিমেষে। চাপ ও তাপের ব্যাপার নেই, ফিউশন হয়ে গেল ঘরের তাপমাত্রায়! এ জন্য এই ব্যাপারকে আখ্যা দেওয়া হল কোল্ড ফিউশন। গবেষণাপত্রটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জার্নালে না ছাপিয়ে ফ্লেশম্যান এবং পনস ঘোষণা করেন তাঁদের ‘সাফল্য’ এক সাংবাদিক সম্মেলনে। সতীর্থ বিজ্ঞানীরা এতে চটে যান। তবে, কোল্ড ফিউশন গবেষণা লেটেস্ট ফ্যাশন হয়ে দাঁড়ায় নানা দেশে। পরে অবশ্য কোল্ড ফিউশন বিভ্রম হিসেবে গণ্য হয়। এখন কোল্ড ফিউশনকে ‘ফ্রিঞ্জ সায়েন্স’ গবেষণা ধরা হয়, যে-হেতু কোনও কোনও ল্যাবরেটরি ওই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।