—ফাইল চিত্র ।
কতটা পথ পেরোলে তবে ধর্ম পাল্টানো যায়? ইলাহাবাদ হাই কোর্ট সম্প্রতি জানাল, ভারতীয় নাগরিকের ধর্ম পরিবর্তনের অধিকার রয়েছে বটে, তবে তাঁকে ধর্ম পাল্টে ফেলার ‘উপযুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ও দাখিল করতে হবে। নাগরিকের স্বেচ্ছায় ধর্ম পরিবর্তনের মৌখিক বা লিখিত বিবৃতি যথেষ্ট নয়, তা জানাতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে, যাতে সরকারি নথি ও পরিচয়পত্রে সেই পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়। এখানেই শেষ নয়, নাগরিককে ধর্ম পরিবর্তনের তথ্যটি বিজ্ঞাপিত করতে হবে তাঁর এলাকায় ‘ব্যাপক প্রচারিত’ সংবাদপত্রেও, সেখানে থাকতে হবে নাম, বয়স, ঠিকানার তথ্য; তারও পরে তা প্রকাশের আবেদন করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যাশনাল গেজেটে। কর্তৃপক্ষ আবেদন খতিয়ে দেখবেন, সব ঠিক থাকলে তা চূড়ান্ত সম্মতি পাবে।
আদালতের পর্যবেক্ষণ, যাতে ধর্ম পরিবর্তনের মধ্যে প্রতারণা মিশে না থাকে, তা যাতে দেশের আইন ভঙ্গ না করে, সে জন্য। এই কারণেই সরকারকে জানানো, খবরকাগজে বিজ্ঞাপন, ন্যাশনাল গেজেটে আবেদনের মতো পথ বেঁধে দেওয়া। বিচারব্যবস্থার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই এই পর্যবেক্ষণ নিয়ে কিছু প্রশ্ন তোলা দরকার। আদালত নাগরিককে উল্লিখিত পদক্ষেপগুলি করতে বলছে তাঁর ধর্ম পরিবর্তনকে পূর্ণাঙ্গ আইনি বৈধতা ও স্বচ্ছতা দিতে, কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা— আজকের ভারত-শাসকেরা নাগরিকের ধর্ম পরিবর্তনকে ‘অধিকার’ হিসাবে স্বীকৃতি দেন কি? তাঁদের কাছে ধর্ম পরিবর্তন মাত্রেই ‘ধর্মান্তরণ’-এ পর্যবসিত, এমন প্রতিটি ঘটনাকে মাপা হয় সন্দেহ ও হিংসার আতশকাচে, আদালতের তা অজানা নয়। বস্তুত গত বছর জানুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টও বলেছিল, সব ধর্মান্তরণই বেআইনি নয়। তার পরেও ভারতের শাসক দল ও তার উগ্র সমর্থককুল দেশ জুড়ে ধর্মান্তরণের বিরুদ্ধে তাদের হুমকি হেনস্থা অত্যাচার হিংসা কিছুই বন্ধ করেনি, ভিন্ন ধর্মে প্রেমসম্পর্ক ও বিয়েকে ক্রমাগত কাঠগড়ায় তুলেছে ‘লাভ জেহাদ’ বলে, উত্তরপ্রদেশ হরিয়ানা গুজরাত হিমাচল উত্তরাখণ্ড-সহ একের পর এক রাজ্য সরকার ধর্মান্তরণ আটকাতে চালু করেছে কঠোর আইন।
প্রশাসন ও আইন যখন অসহায়; স্বার্থান্ধের কুক্ষিগত, তখন নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করতে ভরসা আদালতই। শঙ্কা জাগে, ধর্ম পরিবর্তনকে মান্যতা দিতে আদালত যে ধাপগুলি বেঁধে দিল, তা এই ভারতে নাগরিকের পথ প্রশস্ত করার পরিবর্তে তাকে প্রতি পদে অপদস্থ করবে না তো? আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা আমেরিকার একটি কমিশন গত বছরেই ভারতের নানা রাজ্যের ধর্মান্তরণ আইনগুলি সম্পর্কে বলেছিল, এতে ভারতীয়দের হেনস্থা বহুগুণ বাড়বে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আরও বিপন্ন হবেন, বাড়বে শাসকের নজরদারি, হিংসা। এক বছর পর পরিস্থিতির উন্নতি তো হয়ইনি, বরং লোকসভা নির্বাচনের গরম হাওয়ায় রাজ্যে রাজ্যে ধর্মান্তরণ-বিরোধিতাকে হাতিয়ার করে নেতাদের সংখ্যালঘু-বিষোদ্গার, ধর্মীয় মেরুকরণই হয়ে উঠেছে প্রখর বাস্তব। এই ঘূর্ণিপাকে ক্রমে মুছে যাচ্ছে নাগরিকের স্বেচ্ছায় ধর্ম পরিবর্তনের স্বাভাবিক সাংবিধানিক অধিকার। এই প্রশ্নটি রয়ে গেল: আদালতের নির্দেশমতো নাগরিককে যদি তাঁর ধর্ম পরিবর্তন সংক্রান্ত তথ্য রাষ্ট্রকে জানাতে হয়, রাষ্ট্র যে নাগরিকের দমন-পীড়নেই সে সব ব্যবহার করবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়!