নির্বাচন কমিশন। ফাইল চিত্র।
ছিল আট, হল ছয়। ভারতে ‘জাতীয় দল’-এর সংখ্যা কমল। নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক ঘোষণা অনুসারে, জাতীয় দলের পঙ্ক্তিতে স্থান পেয়েছে আম আদমি পার্টি এবং আসন হারিয়েছে এনসিপি, তৃণমূল কংগ্রেস ও সিপিআই, এখন থেকে তারা ‘রাজ্য দল’। স্থানচ্যুত দলগুলির কোনও কোনও মহল থেকে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের কথা হাওয়ায় ভেসেছে বটে, তবে এখনও সেই হাওয়া জোরদার হয়নি, সম্ভবত হবেও না। কতকগুলি নির্দিষ্ট মাপকাঠির ভিত্তিতে— আইনসভার নির্বাচনে অন্তত চারটি রাজ্যে ভোটপ্রাপ্তি, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সংখ্যা, ইত্যাদি ক্ষেত্রে ন্যূনতম নির্ধারিত মাত্রার সাফল্য দেখাতে পারলে তবেই জাতীয় দলের স্বীকৃতি পাওয়া এবং ধরে রাখা যায়। মাপকাঠির চরিত্র বা তার নির্ধারিত মাত্রাগুলি সম্পর্কে মতানৈক্য থাকতেই পারে, কিন্তু সাধারণ ভাবে স্বীকৃতি স্থির করবার প্রক্রিয়াটিকে অযৌক্তিক বলা চলে না। ২৮টি রাজ্য (এবং ৮টি কেন্দ্রশাসিত এলাকা) সম্বলিত দেশে জাতীয় দল হিসাবে অভিহিত হওয়ার জন্য অন্তত কয়েকটি রাজ্যের নির্বাচনী পরিসরে ন্যূনতম জনসমর্থনের শর্ত পূরণ করা দরকার, বিশেষ করে স্বীকৃত জাতীয় দলগুলি যে-হেতু কিছু কিছু বিশেষ সুযোগ পেয়ে থাকে। অন্য দিকে, তালিকায় রদবদলের জঙ্গম প্রক্রিয়াটি থেকে বিভিন্ন দল দেশের নানা রাজ্যে বা অঞ্চলে ভোটদাতাদের সমর্থন বা আস্থা অর্জনের প্রতিযোগিতায় কতটা সফল বা সফল নয় তার আংশিক হলেও, হদিস মেলে। নির্বাচনী গণতন্ত্রে এই ধারণাগুলি মূল্যবান।
প্রশ্ন উঠতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় জাতীয় দল নামক ধারণাটির গুরুত্ব কতখানি? এই প্রশ্ন নিছক নির্বাচন কমিশনের পরীক্ষা পাশের ব্যাপার নয়, রাজনীতির গভীর বাস্তবের বিষয়। সেই গভীরতর অর্থে, স্বাধীন ভারতের প্রথম পর্বে কংগ্রেসই ছিল ‘স্বভাবত’ জাতীয় দল। দেশ জুড়ে আইনসভায় ও প্রশাসনে তার আধিপত্য কার্যত অবিসংবাদিত, কিন্তু সে নিজেই চরিত্রে একটি রাজনৈতিক মঞ্চবিশেষ, যেখানে বহু গোষ্ঠী ও মতের সহাবস্থান স্বাভাবিক বলেই গণ্য হত। ষাটের দশকের মধ্যপর্ব থেকে রজনী কোঠারি কথিত ‘কংগ্রেস সিস্টেম’-এর ভাঙন শুরু হল, ক্রমে উত্থান হল নানা আঞ্চলিক দলের, অতঃপর প্রবল আকার ধারণ করল পরিচিতির রাজনীতি। এই পর্বেও অনেক দিন অবধি লোকসভা নির্বাচনের পরিসরে রাজনীতি বিন্যস্ত ছিল কেন্দ্রে ‘জাতীয়’ কংগ্রেস এবং তার পাশে বা— অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিরুদ্ধে— বিভিন্ন দল বা জোট, এই ভাবেই। ক্রমশ পট যায় ঘুরে। ভারতীয় জনতা পার্টি ‘স্বাভাবিক’ জাতীয় দল হিসাবে মাঝমাঠের দখল নেয়, গত এক দশকে সেই আধিপত্য এক অতিকায় আকার ধারণ করেছে। জাতীয় দলের প্রশ্নটি এই পরিপ্রেক্ষিতেই নতুন করে বিচার-বিশ্লেষণের দাবি জানায়।
সঙ্ঘ পরিবারের দর্শনে জাতীয়তার যে একমাত্রিক ধারণাকে একমাত্র ধারণা বলে গণ্য করা হয়, নরেন্দ্র মোদীর জমানায় তার দাপট আক্ষরিক অর্থেই অভূতপূর্ব আকার ধারণ করেছে। তার প্রতিস্পর্ধী জাতীয়তার ধারণা যদি দেশবাসীর সামনে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে ও প্রত্যয়ের সঙ্গে পেশ করা না যায়, তা হলে কোনও দলই নির্বাচন কমিশনের তকমা দিয়ে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারবে না। বলা নিষ্প্রয়োজন, সেই প্রতিস্পর্ধী জাতীয়তাকে গড়ে তুলতে হবে উদার বহুত্ববাদ এবং সর্বজনীন সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তিতে। সেটাই হতে পারে জাতীয় রাজনীতিতে প্রকৃত বিরোধী সমন্বয়ের মৌলিক যোগসূত্র। ভারতীয় গণতন্ত্রের কাঠামোটিকে রক্ষা করার স্বার্থে বিরোধী দলগুলির কাজ এখন সেই ভিতটি গড়বার এবং তার উপর দাঁড়িয়ে যোগসূত্র রচনার। গণতন্ত্রের কাঠামোটিই যদি না বাঁচে, তবে কোন দল ক’টি রাজ্যে কত শতাংশ ভোট বা ক’টি আসন ঝুলিতে সংগ্রহ করে জাতীয় দলের শিরোপা পেল বা হারাল, সেই সব অঙ্ক পাটিগণিতের বইয়ের পাতায় স্থান পাবে। রাজনীতি পাটিগণিত নয়।