প্রজাদের তাঁবে রাখার অনুশীলনেই তাঁদের প্রজাতন্ত্র উদ্যাপিত হবে। ছবি: পিটিআই।
বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের এক সন্ধিক্ষণে, ১৯৩০ সালে যে দিনটিতে ‘পূর্ণ স্বরাজ’-এর অঙ্গীকার ঘোষিত হয়, ঠিক দু’দশক পরে সেই তারিখটিকে সদ্য-স্বাধীন দেশের প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে নির্দিষ্ট করার সিদ্ধান্ত কেবল সুচিন্তিত ছিল না, তার তাৎপর্য ছিল সুগভীর। এই দিনটিই ভারতীয় সংবিধানের জন্মদিবস, যে সংবিধান গ্রহণ করেছি ‘আমরা, ভারতের জনসাধারণ’। প্রজাতন্ত্র শব্দটির মধ্যেই নিহিত আছে সেই প্রস্তাবনার প্রগাঢ় অর্থ: দেশ স্বাধীন হয়েছে; এত দিন যারা প্রজা ছিল, এ বার জারি হবে তাদের স্বনিয়ন্ত্রণের সম্যক বিধান, বলবৎ হবে প্রজার তন্ত্র। আত্মশাসনের এই মৌলিক ধারণাটিই প্রজাতন্ত্রের প্রাণ। সংবিধানের মধ্য দিয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতিমায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল। জন্মমুহূর্ত থেকে বরাবর সেই গণতন্ত্রকে বহু বিপদ, বহু সঙ্কট, বহু আঘাতের মোকাবিলা করতে হয়েছে; সেই পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পথে তাকে একই সঙ্গে আলো দেখিয়েছে, রক্ষা করেছে এবং সাহস দিয়েছে এই প্রজাতন্ত্রের অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি।
প্রতিমা আজও বিরাজমান, কিন্তু তার প্রাণশক্তির কতটুকু অবশিষ্ট আছে? নির্বাচন হচ্ছে, দলীয় রাজনীতির নায়ক-নায়িকারা নির্বাচনের প্রচারে রকমারি প্রতিশ্রুতি এবং জুমলা বিতরণ করছেন, জনসাধারণ ভোট দিচ্ছেন, সেই ভোটে সফল হয়ে শাসকরা ক্ষমতায় আসছেন, দেশ চালাচ্ছেন, কিন্তু এই ব্যবস্থায় ‘প্রজার তন্ত্র’ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সেই তন্ত্রের প্রথম এবং প্রধান শর্ত হল এই যে, শাসকরা জনসাধারণের কথা শুনবেন এবং রাষ্ট্রনীতির নির্ধারণে ও রূপায়ণে তাঁদের মতামতকে মূল্য দেবেন, মর্যাদা দেবেন। স্পষ্টতই, এই শর্ত পূরণের প্রকৃত মাপকাঠি হল বিরোধী মতের স্বীকৃতি, যে বিরোধী মতের পক্ষে কত শতাংশ ভোট পড়েছে সেটা গৌণ প্রশ্ন, বিরোধী মত বলেই তা গুরুত্বপূর্ণ। যথার্থ প্রজাতন্ত্র দাঁড়িয়ে থাকে এই গুরুত্বের স্বীকৃতির উপরেই। যে শাসক প্রতিস্পর্ধী অবস্থানকে মানতে পারে না, বিবাদী স্বর শুনলেই দমন করতে তৎপর হয়, সে প্রজাতন্ত্রের ধারক নয়, ঘাতক।
বিরোধী মত দূরস্থান, ভারতের বর্তমান শাসকরা প্রশ্ন শুনতেও নারাজ। নাগরিকদের সঙ্গে কোনও ধরনের কথোপকথনে তাঁদের বিন্দুমাত্র রুচি নেই। শুশ্রূষার এই সম্পূর্ণ অভাব যাঁর আচরণে সর্বাধিক প্রকট, তাঁর নাম নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রীর আসনে তাঁর শত মাস অতিক্রান্ত হয়েছে, আজ অবধি যথার্থ কোনও প্রশ্নোত্তরের পরিসরে তাঁকে দেখা যায়নি, সাক্ষাৎকারের নামে যা দেখা গিয়েছে তা বড়জোর এক ধরনের নাটক। এহ বাহ্য। বিরোধী মত বা প্রতিকূল প্রশ্ন যাঁরা করেন তাঁদের জন্য নির্ধারিত হয়েছে ‘আর্বান নকশাল’, ‘আন্দোলনজীবী’ ইত্যাদি রকমারি তিরস্কার এবং (অ)প্রচ্ছন্ন হুমকি। সম্প্রতি সেই হুমকির মাত্রা এক পর্দা চড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ‘কলমধারী’ প্রতিপক্ষকেও কার্যত বন্দুকধারীর সঙ্গে একাকার করে দিয়েছেন। এই অসহিষ্ণুতা যে ফাঁকা কথা নয়, তার প্রমাণও মিলেছে পদে পদে; বিরোধী রাজনীতিক, সমাজকর্মী, মানবাধিকার আন্দোলনের সংগ্রামী ইত্যাদি বিভিন্ন বর্গের নাগরিক এবং প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় রোষের কবলে পড়েছে, পরিণতি— দীর্ঘ হয়রানি, কারাবাস, মৃত্যু অবধি। সরকারি মতে প্রজাতন্ত্র দিবসের আড়ম্বর যখন জমে উঠছে, ঠিক সেই সময়েই একটি বিদেশি গণমাধ্যমের তৈরি তথ্যচিত্রের বিরুদ্ধে দিল্লীশ্বররা যে ভাবে মহাযুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, তার নিহিত পরিহাস কোনও সচেতন নাগরিকের নজর এড়াতে পারে না। স্পষ্টতই, এই শাসকরা নাগরিক চান না, চান আদি ও অকৃত্রিম প্রজা, যে প্রজা বিনা প্রশ্নে তাঁদের সমস্ত আধিপত্য স্বীকার করে নেবেন। প্রকৃত গণতন্ত্র নয়, তার মোড়কে নির্ভেজাল সংখ্যাগুরুবাদই এই রাষ্ট্রচালকদের ধর্ম। প্রজাদের তাঁবে রাখার অনুশীলনেই আজ তাঁদের প্রজাতন্ত্র উদ্যাপিত হবে।