কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু। ফাইল চিত্র।
সরকারের সমালোচনা মানেই দেশের বিরোধিতা, প্রকাশ্যে বললেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু, এবং এই ভ্রান্ত, স্পর্ধিত আক্রমণে বিদ্ধ করলেন প্রাক্তন বিচারপতিদেরও। এক আলোচনাসভায় রিজিজু অভিযোগ করেন, কিছু প্রাক্তন বিচারপতি বিরোধী দলের সদস্যের মতো আচরণ করছেন— প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করে বিচারব্যবস্থাকে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। সংবিধান সুরক্ষার শপথ নিয়েছেন যে মন্ত্রী, তিনি সরকার এবং রাষ্ট্রের পার্থক্য জানেন না, বিরোধী কণ্ঠস্বরের মূল্য স্বীকার করেন না, এবং সর্বোপরি বিচারপতিদের মর্যাদাকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করতে দ্বিধা করেন না— এতগুলি ভয়ানক সত্যের আঘাত সহ্য করা কঠিন। ‘দেশবিরোধী’ কাজের জন্য প্রাক্তন বিচারপতিরাও ছাড় পাবেন না, এ কথা বলে রিজিজু শোভন-অশোভনের সীমা তো অতিক্রম করলেন বটেই, উচিত-অনুচিতের লক্ষ্মণরেখাও পার করলেন। তিনশোরও বেশি আইনজীবী একটি চিঠি লিখে আইনমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, সরকার দেশ নয়, এবং সরকারের বিরোধিতাকে দেশের প্রতি বিদ্বেষ বলে কখনওই গণ্য করা চলে না। তাঁরা মনে করিয়েছেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ বছর সংসদে তাঁর একটি ভাষণে বলেছিলেন যে, সরকারি কাজের কঠোর সমালোচনা সরকারকে সতর্ক এবং সক্রিয় রাখে। অথচ, তাঁরই সরকারের আইনমন্ত্রীর গলায় বাজল অন্য সুর। সাংসদ এবং আইনমন্ত্রী হিসাবে সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা, বিচারব্যবস্থার সুরক্ষা এবং প্রাক্তন ও বর্তমান বিচারপতিদের সুরক্ষা বিধানই রিজিজুর কর্তব্য। যাঁদের সঙ্গে তিনি সহমত নন, সেই প্রাক্তন বিচারপতিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা করার ভয় দেখানো তাঁর কর্তব্য নয়, মনে করিয়েছেন আইনজীবীরা।
স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও এক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে বোঝাতে হচ্ছে যে, সরকারের ভ্রান্তি প্রকাশ্যে আনা দেশপ্রেমিকেরই কাজ— এতে ভারতে গণতন্ত্রের সঙ্কট ফের প্রকট হল। পরাধীন দেশে নবজাগরণের উষাকালে রামমোহন রায় ঔপনিবেশিক সরকারকে মনে করিয়েছিলেন, সমালোচকের কণ্ঠ রুদ্ধ করলে প্রশাসক জানতে পারে না, কোথায় অপশাসন হচ্ছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সব সরকারই বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে কম-বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালকে তার পূর্ববর্তী কোনও সময়ের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। বর্তমানে বিরোধীর বিপন্নতা এক অন্য পর্যায়ে পৌঁছেছে। সমালোচকদের ‘দেশদ্রোহী’ বলে চিহ্নিত করার, কঠোর আইনি ব্যবস্থা করার যে প্রবণতা এখন দেখা যাচ্ছে, তা ভয়ঙ্কর। নাগরিক সমাজের যে অংশ সরকারের সমালোচক, দেশে গণতন্ত্রের ক্রমক্ষীয়মাণ পরিসরটি নিয়ে উদ্বিগ্ন, বর্তমান সরকার তাঁদের শায়েস্তা করতে উদ্গ্রীব বলে অভিযোগ উঠছে বার বার। সাংবাদিক, সমাজকর্মীরা আগেই রোষের আঁচ পেয়েছেন। এ বার প্রাক্তন বিচারপতিদের প্রতি অনতিপ্রচ্ছন্ন হুমকি এল। এই স্পর্ধা আশ্চর্য না করে পারে না।
দেশপ্রেম ও নাগরিক অধিকারের যে মৌলিক কথাগুলি কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীকে মনে করালেন ভারতের মুখ্য আইনজীবীরা, তা সমগ্র নাগরিক সমাজেরই কথা। গণতন্ত্রে সরকারের সমালোচনার পরিসর কেবলমাত্র সংসদ-বিধানসভা, কিংবা কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত নয়। শান্তিপূর্ণ ও সংবিধানসম্মত উপায়ে সরকারের কাজের প্রতিবাদ করতে পারে যে কোনও ব্যক্তি বা সংগঠন। প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে সমালোচককে হয়রানি করার এক্তিয়ার নেই সরকারের। প্রাক্তন বিচারপতিরাও সরকারের সমালোচনার জন্য ‘ছাড়া পাবেন না,’ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই প্রকাশ্য ঘোষণা বস্তুত সমগ্র নাগরিক সমাজের প্রতি উদ্ধত বার্তা। ফলে কেবল সংবিধান-প্রদত্ত অধিকার রক্ষা করতে আজ সরকারের প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠতে হচ্ছে নাগরিককে।