২০২২-এর ডিসেম্বরের তুলনায় এই জানুয়ারিতে খাদ্যশস্যের মূল্যস্ফীতি ঘটেছে ২.৬ শতাংশ। প্রতীকী ছবি।
জানুয়ারির মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান দেখে অনেকেই বিস্মিত। সম্ভবত রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কও। কনজ়িউমার প্রাইস ইন্ডেক্স (সিপিআই) বা খুচরো মূল্যস্ফীতির হার এই জানুয়ারিতে পৌঁছল তার তিন মাসের সর্বোচ্চ স্তরে— ৬.৫২ শতাংশে। গোটা ২০২২ সাল জুড়েই মূল্যস্ফীতির যে তাণ্ডব চলেছে, তাতে এই হারকে খুব অস্বাভাবিক রকম বেশি মনে হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক মূল্যস্ফীতির যে পূর্বাভাস দিয়েছিল, এবং তাঁর বাজেটে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে যতখানি আত্মবিশ্বাসী অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই হারটি উদ্বেগজনক। আরও চিন্তার কথা হল, গত দু’মাসে মূল্যস্ফীতির হার নিম্নমুখী হয়েছিল। অতএব ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের কঠোর আর্থিক নীতি ফলপ্রসূ হয়েছে। জানুয়ারি মাসের পরিসংখ্যান সেই স্বস্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলল। দেখা যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি ঘটেছে খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে— বিশেষত খাদ্যশস্যে, যাতে গত বছরের জানুয়ারি মাসের তুলনায় মূল্যস্ফীতি ঘটেছে ১৬.১ শতাংশ। ২০২২-এর ডিসেম্বরের তুলনায় এই জানুয়ারিতে খাদ্যশস্যের মূল্যস্ফীতি ঘটেছে ২.৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির এই হার বজায় থাকলে বাজেটের হিসাবেও তার প্রভাব পড়া স্বাভাবিক, কারণ অর্থমন্ত্রী যে হিসাব কষেছেন, তাতে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের নীচে ধরা হয়েছে।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক সম্প্রতি মূল্যস্ফীতির যে পূর্বাভাস দিয়েছিল, তাতে জানুয়ারি থেকে মার্চ, এই ত্রৈমাসিকে মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছিল ৫.৭ শতাংশ। এ কথা সত্যি যে, এক মাসের মূল্যস্ফীতিতে গোটা ছবিটা পাল্টে যায় না। কিন্তু, এ কথাও একই রকম সত্যি যে, জানুয়ারির পরিস্থিতি ব্যাঙ্ককে উদ্বিগ্ন করবে। অতএব প্রশ্ন হল, ব্যাঙ্কের প্রতিক্রিয়া কী হবে? সুদের হার কি আরও বাড়বে? কয়েক দিন আগেই ব্যাঙ্ক সুদের হার ০.২৫ শতাংশ-বিন্দু বাড়িয়েছে— রেপো রেট এখন দাঁড়িয়েছে ৬.৫ শতাংশে, গত চার বছরের মধ্যে সর্বাধিক। সুদের হার আর বাড়ানো হবে না, এমন কোনও আশ্বাসও ব্যাঙ্ক দেয়নি। ফলে, আরও এক বা একাধিক দফা সুদবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাজারে প্রত্যাশা ছিল যে, সুদের হার তার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গিয়েছে, এবং এর পর কিছু দিন সেই হার স্থির থাকবে, পরিস্থিতি বুঝে পরে তা নিম্নমুখী হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের জন্য রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস দিয়েছিল ৫.৩ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের একাংশের মত ছিল যে, মূল্যস্ফীতি আরও কম হতে পারে। জানুয়ারির পরিসংখ্যানে সেই অনুমানগুলি প্রশ্নের মুখে পড়ায় সুদের হার আরও বাড়ার স্পষ্ট সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অর্থব্যবস্থার উপর তার কী প্রভাব পড়বে, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককে অবশ্য সে কথাও ভাবতে হবে।
ভাবতে হবে আরও একটি কথা— ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় এখন যে কারণে মূল্যস্ফীতি ঘটছে, সুদের হার বাড়িয়ে কি তাকে আদৌ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? এই মুদ্রানীতির পিছনে যে পূর্বানুমান রয়েছে, তা হল, অর্থব্যবস্থা তার পূর্ণশক্তিতে চলছে, এবং মূল্যস্ফীতি হচ্ছে বাড়তি চাহিদার কারণে। ভারতের ছবিটি অভ্রান্ত ভাবে আলাদা। কর্মসংস্থানহীনতা, শ্লথ মজুরি বৃদ্ধির হার, বাজারে নিম্ন চাহিদা, এবং বিনিয়োগে শ্লথতা— সব মিলিয়ে অনুমান করা চলে যে, ভারতের সমস্যা উদ্বৃত্ত চাহিদা নয়, অপ্রতুল জোগান। সেই ক্ষেত্রে, কঠোরতর আর্থিক নীতি বিনিয়োগকে আরও প্রশ্নের মুখে ফেলবে। কর্মসংস্থানও গতিহীন থাকবে। ফলে, সুদের হার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতিতে লাগাম পরানো কঠিন হবে— বস্তুত, জানুয়ারির পরিসংখ্যান তেমনই ইঙ্গিত করছে। কিন্তু, অর্থব্যবস্থা যদি কঠোর মুদ্রানীতির শৃঙ্খলে বাধা পড়ে থাকে, তবে সাধারণ মানুষের সমস্যা— আয় বাড়ছে না, অথচ খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে, এই অবস্থা কাম্য হতে পারে না।