New Parliament Building

আধোআধো কেন

কিন্তু বিরোধী শিবিরের রাজনীতিকরা? না, তাঁরা একেবারে নির্বাক নন। প্রথম দিন থেকেই প্রতিবাদ করেছেন। তাঁদের চাপেই বিষয়টি প্রিভিলেজ কমিটিতে পাঠানোর কথা চলছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:৫৮
Share:

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

মহা আড়ম্বরে সদ্য-উদ্ঘাটিত সংসদ ভবনে লোকসভার বিশেষ অধিবেশনে শাসক দলের জনপ্রতিনিধি অন্য এক সাংসদের উদ্দেশে ধর্মীয় বিদ্বেষের গরলাক্ত বাক্যবাণ নিক্ষেপ করছেন— এই ঘটনা যত ভয়ঙ্করই হোক, তাকে অভাবনীয় বলার কোনও উপায় নেই। সংসদের বাইরে যে বিদ্বেষের বিপুল কাটতি, ভিতরেও তার অনুপ্রবেশ হয়তো অনিবার্য ছিল। নগর পুড়লে দেবালয় অক্ষত থাকে না। দক্ষিণ দিল্লির পরাক্রমী সাংসদের ওই কুৎসিত উচ্চারণের রসাস্বাদন করেই তাঁর দলের একাধিক নেতা হাসছিলেন কি না, সে বিষয়ে তদন্ত কমিটি বসানোর কোনও প্রয়োজন নেই। এমন উক্তিতে একটি সভ্য সমাজে দলমত নির্বিশেষে সমবেত সমস্ত জনপ্রতিনিধির সমস্বরে প্রচণ্ড প্রতিবাদ এবং ধিক্কার জানানোর কথা ছিল। প্রবীণ সাংসদ এবং ভূতপূর্ব মন্ত্রীরা তা নিয়ে হেসেছেন না অন্য কোনও বিশ্রম্ভালাপের প্রেরণায়— এই প্রশ্ন যে উঠতে পারে, সেটুকুই এক কথায় ভয়াবহ। এবং, এই আচরণের জন্য অবিলম্বে যাঁর কঠোর শাস্তির প্রয়োজন ছিল, তাঁর উদ্দেশে এ-যাবৎ কিছু লোকদেখানো তিরস্কার বা কৈফিয়ত চাওয়াই সার হয়েছে। তাঁর আচরণকে সংসদের প্রিভিলেজ কমিটির দরবারে পাঠানো হবে কি না, অন্তত চার দিন ধরে সেই বিষয়ে জল্পনাই সার। স্পষ্টতই, শাসক দলের সাংসদের ‘বাক্‌স্বাধীনতা’ অসীম এবং অপার।

Advertisement

কিন্তু বিরোধী শিবিরের রাজনীতিকরা? না, তাঁরা একেবারে নির্বাক নন। প্রথম দিন থেকেই প্রতিবাদ করেছেন। তাঁদের চাপেই বিষয়টি প্রিভিলেজ কমিটিতে পাঠানোর কথা চলছে। কিন্তু সে সবই যেন গান্ধী-পূর্ব কংগ্রেসের আবেদনপত্র লেখার ঢঙে। অপরাধের গুরুত্বের সঙ্গে এই এক আনা প্রতিবাদ বা দু’আনা চাপের রাজনীতি কি আদৌ মানানসই? এমন একটি প্রশ্নে প্রবল প্রতিবাদ সংগঠিত করাই কি বিরোধী রাজনীতির একটা বড় দায়িত্ব ছিল না? বস্তুত, যে পারস্পরিক সমন্বয় এবং সহযোগিতার ভিত্তিতে ‘ইন্ডিয়া’ নামক মঞ্চটি গড়ে তোলার কাজ চলছে, শাসক দলের জনপ্রতিনিধির এই বিদ্বেষ-ভাষণের প্রতিবাদ তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ হয়ে উঠতে পারত। কেন তা হয়নি? তাঁরা কি ভয় পাচ্ছেন? এই ভয় যে, সংখ্যালঘুর প্রতি গালিবর্ষণের বেশি প্রতিবাদ করতে গেলে সংখ্যাগুরু সমাজ বিরূপ হতে পারে, সেই বিরূপতা ভোটের অঙ্কে লোকসান ঘটাতে পারে? অতএব, ধীরে চলার এবং রেখেঢেকে বিরোধিতা করার সতর্ক নীতি? বিরোধীরা কি তালকে তিল করতে যারপরনাই যত্নবান?

এই সংশয় সত্য হলে বুঝতে হবে, এই বিরোধীরা রাজনীতি বলতে কেবল ভোটের অঙ্ক মেলানোর পাটিগণিত বোঝেন, সুতরাং তাঁদের সমন্বয়ের প্রথম এবং শেষ কথা আসন নিয়ে বোঝাপড়া, হিন্দুত্ববাদী সংখ্যাগুরুতন্ত্রের প্রতিস্পর্ধী যথার্থ গণতান্ত্রিক বিকল্প ভারতের ধারণা তুলে ধরার সাহস বা সদিচ্ছা তাঁদের নেই। এই কারণেই বোধ করি আজও, বৈঠকের পর বৈঠকে বসেও, তাঁরা একটি ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচির ধারেকাছে পৌঁছতে পারেননি। অথচ বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের উৎকট আধিপত্যবাদের বিপরীতে নিজেদের সাধারণ অবস্থানটিকে নির্দিষ্ট করা আদৌ কঠিন ছিল না। বস্তুত, শাসকের অসহিষ্ণুতা এবং বিদ্বেষ এমন একটি রূপ নিয়েছে, যাকে কেবল ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী বলা যথেষ্ট নয়, তা গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তকেই লঙ্ঘন করছে, বস্তুত সভ্যতার ভিত্তিমূলেই প্রচণ্ড আঘাত করে চলেছে। সংসদের ইতিহাসে ‘অভূতপূর্ব’ যে উক্তিটি সে দিন শোনা গেল, তা কেবল একটি ধর্মের অনুসারী মানুষকে অপমান করেনি, মনুষ্যত্বকে অপমান করেছে। তার পরেও বিরোধী রাজনীতিকরা এই অপমানের সমস্বর প্রতিবাদে যথেষ্ট সরব এবং সচল হবেন না? কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী সম্প্রতি বিরোধী শিবিরের যে নতুন ‘নমনীয়তা’র গুণগান করেছেন, তা কি তবে সর্বংসহা হওয়ার নমনীয়তা? ভারতীয় গণতন্ত্র তাঁদের কাছে এই প্রশ্নের সদুত্তর চাইছে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement