প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: রয়টার্স।
রাজার কাপড় কোথায়, এই ভারতের মহামানবকে এ-হেন প্রশ্ন করা কতখানি কঠিন, সাবরিনা সিদ্দিকি নির্ঘাত টের পেয়েছেন। তবুও তো তিনি এক জন সাংবাদিকমাত্র, বড় জোর হোয়াইট হাউসের আশীর্বাদধন্যা। ভারতে সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে নিতান্ত মৃদুস্বরে প্রশ্ন করার ফলে আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, একদা নরেন্দ্র মোদীর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ মিত্র ‘বারাক’-কেই যে পরিমাণ আক্রমণের সম্মুখীন হতে হল, তাতে বিশ্ববাসীর বোঝা উচিত, ভারতে দাঁড়িয়ে এমন প্রশ্ন করলে কী হয়। বিভিন্ন জেলে, বিভিন্ন ধারার মামলায় আটক নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও তার সাক্ষ্য দিতে পারেন। সাবরিনার প্রশ্নের উত্তরে হোয়াইট হাউসের সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের বিস্তর জয়গান গিয়েছিলেন। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে সেই গানের সুর যে ভারতে পৌঁছয়নি, গত কয়েক দিনেই তার বিস্তর উদাহরণ মিলল। বিহারে গোরক্ষকরা এক মুসলমান প্রৌঢ়কে পিটিয়ে হত্যা করল— অভিযোগ, তিনি নাকি গরুর হাড় পাচার করছিলেন। উত্তরাখণ্ডের পুরোলা শহরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের হুমকিতে প্রকাশ্যে ইদের নমাজ বন্ধ রাখা হল। গণতন্ত্র সম্বন্ধে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ধারণা স্পষ্ট বা গভীর, তেমন দাবি করার উপায় নেই— নাগপুরের পাঠশালায় গণতন্ত্রের পাঠ দেওয়া হয় না— কিন্তু সম্ভবত তিনিও বুঝবেন যে, এই ঘটনাগুলি গণতন্ত্রের উজ্জ্বল বিজ্ঞাপন নয়। অন্তত, গণতান্ত্রিক বিশ্বের দরবারে তিনি নিজের যে ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান, দেশে ঘটে চলা ঘটনাক্রম তার পক্ষে অনুকূল নয়। অনুমান করা চলে, ভারতের জল-হাওয়ায় এমন কোনও গুণ আছে, যাতে দেশে ফিরলেই প্রধানমন্ত্রীরও আর গণতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ থাকে না।
কথাটি হিমন্তবিশ্ব শর্মার মতো নেতারা বিলক্ষণ জানেন। ফলে তাঁরা নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারেন যে, আপাতত তাঁরা ভারতের ‘হুসেন ওবামা’দের শায়েস্তা করবেন। কাদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছেন, ভেঙে বলার প্রয়োজন নেই— তাঁর চেয়ে বড় দরের নেতারা পোশাক দেখে লোকের ধর্ম চিনতে পারেন, অথবা বুঝতে পারেন কে বা কারা ‘ছারপোকা’। দেশের বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশের জনসংখ্যায় মুসলমানদের অনুপাত যত, জেলবন্দিদের মধ্যে মুসলমানদের অনুপাত তার দ্বিগুণ। যোগী আদিত্যনাথ থেকে শিবরাজ সিংহ চৌহান, সকলেই জানেন যে, কাদের ঠান্ডা করতে ঘরবাড়ির উপর বুলডোজ়ার চালিয়ে দেওয়া বর্তমান ভারতে বৈধ। অনুরাগ ঠাকুর বা নূপুর শর্মারা জানেন, এই ভারতে কোন কথা বললে দোষ নেই। তাঁরা জানেন, তাঁদের বাস্তুতন্ত্রের শীর্ষনেতারা দেশ জুড়ে সেই জানার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছেন।
দেশে আর বিদেশে গণতন্ত্র, সহিষ্ণুতা, গ্রহণশীলতা নিয়ে অবস্থানে এই যে দুস্তর পার্থক্য, সেই ব্যবধান কি নিতান্ত অসেতুসম্ভব— কিপলিং-এর ভাষা ধার করলে, ‘নেভার দ্য টোয়াইন শ্যাল মিট’? ক্ষমতাসীন বিশ্বনেতাদের নজর সচরাচর ভারতের বিপুলায়তন বাজারটির দিকে থাকে— ফলে, বিদেশের রাজদরবারে প্রধানমন্ত্রীর আসন পাতা থাকবেই। তবুও, আশার একটি ক্ষীণ আলোকরেখা রয়েছে কূটনৈতিক ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে থাকা বিদেশি নাগরিক সমাজের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রীর মুখে গণতন্ত্রের জয়ধ্বনিতেই। অনুমান করা চলে যে, দেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘু জনসমাজের প্রতি শাসক দল যে আচরণ করছে, তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীরও খানিক লজ্জা রয়েছে। হয়তো চক্ষুলজ্জাই, কিন্তু সেই লজ্জাটুকুই ভরসা। সম্ভবত কোথাও এই বোধ নিহিত রয়েছে যে, হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপনের অত্যুৎসাহে তাঁরা যে পথে চলেছেন, সে পথটি গৌরবের নয়। বিদেশ থেকে সমালোচনার সামান্যতম ইঙ্গিত মিললেও বর্তমান শাসকরা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। তা কি নিজেদের চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার কারণেই? ভারতীয় গণতন্ত্র আপ্রাণ বিশ্বাস করতে চাইবে যে, সত্যিই এই অস্বস্তিটুকু রয়েছে।