অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
অতিব্যবহারে, জামাকাপড়ের মতোই, দৃশ্যপটের উজ্জ্বলতাও ক্রমশ কমতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে শাসক এবং ‘প্রধান’ বিরোধী দলের বিবিধ স্তরের সদস্যরা যে ভাবে রাজ্য রাজনীতির ছোট নদী পারাপার করে চলেছেন, তাতে দল বদলের চমক ক্রমশ কমে আসার সম্ভাবনা প্রবল। এই বাজারে, সন্দেহ নেই, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগদানের ঘটনাটি নানা কারণে জনপরিসরে কিছু উত্তেজনার সঞ্চার করেছে। প্রথমত, তিনি দল বদল করেননি, খেলাটাই বদলে নিয়েছেন, বিচারপতির আসন ছেড়ে হাতে তুলে নিয়েছেন দলীয় পতাকা। দ্বিতীয়ত, এই সিদ্ধান্ত যে তিনি নিতে চলেছেন, অভিজিৎবাবু সেই খবরটি এক অঙ্ক থেকে পরবর্তী অঙ্কে বিন্যস্ত যে প্রক্রিয়ায় জনসমক্ষে এনেছেন, তা কেবল নাটকীয় নয়, তার চিত্রনাট্য রচনা এবং রূপায়ণের মুনশিয়ানা বাংলার মঞ্চজগতে ঈর্ষার উদ্রেক করতে পারে। তৃতীয়ত, এবং সবচেয়ে বড় কথা, দীর্ঘ সময় যাবৎ বিচারপতির আসনে তাঁর ভূমিকা, বিশেষত তাঁর বিবিধ মন্তব্যের ভাষা ও ভঙ্গি, বহু নাগরিকের মনে তাঁর সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি ও লালন করে চলেছিল, যার ফলে এই নবকলেবর ধারণের ঘোষণা সর্ব অর্থেই বড় খবর হয়ে উঠেছে।
কিন্তু এগুলির কোনওটিই মৌলিক প্রশ্ন নয়। ব্যক্তিগত জীবন ও কর্মপন্থা বিষয়ে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্ত ও সেই সিদ্ধান্ত রূপায়ণের প্রক্রিয়ায় কত গ্রাম নাটকীয়তা বা ক’ছটাক চমক আছে, সেই সব উপকরণ তাঁর রাজনৈতিক ওজন কতটা বাড়াতে পারে এবং তাঁর ‘বেছে নেওয়া’ রাজনৈতিক দলটির পক্ষে সেই ওজন কতটা উপকারী হতে পারে, সে-সব প্রশ্ন থাক। ব্যক্তি গৌণ। মুখ্য প্রশ্নটি একমাত্র নীতি তথা নৈতিকতার। সেই প্রশ্নের মূলে আছে তাঁর গোত্রান্তরের ইতিবৃত্ত। বিচারপতির আসন ছেড়ে দলীয় রাজনীতিতে নাম লেখানোয় আইনগত কোনও বাধা নেই, এমনকি দুই পর্বের মধ্যে একটা ন্যূনতম সময়ের ব্যবধান রাখারও আইনি বাধ্যবাধকতা নেই— কথাগুলি সদ্য-প্রাক্তন বিচারপতি নিজে জানিয়ে দিয়েছেন। বস্তুত, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে দৃশ্যত কিঞ্চিৎ বেশি জোর দিয়েই সে-কথা ঘোষণা করেছেন তিনি। যাঁরা এই প্রশ্ন তুলছেন, তাঁদের আইনের বই পড়ে আসার পরামর্শ দিতেও তিনি পিছপা নন। বিচারকের আসন ছেড়ে এলেও তাঁর প্রতিক্রিয়া এবং পরামর্শে বিচারকসুলভ তিরস্কারের ভঙ্গিটি বেশ প্রকট ছিল।
কিন্তু সম্ভবত তিনি নিজেও বিলক্ষণ জানেন— আইনের ধারা দেখিয়ে নৈতিকতার বিচার হয় না। প্রশ্ন স্বাভাবিক বিবেচনাবোধের। বিচারপতি সমাজের চোখে কেবল সম্মানের পাত্র নন, নৈতিক আদর্শের পরাকাষ্ঠা হিসাবে তাঁর ভূমিকা সংশয়োর্ধ্ব থাকাই কাম্য। বর্তমান ভারতে আদালতের এই গুরুত্ব আরও বহুগুণ বেড়েছে। শাসনবিভাগের আধিপত্যবাদ এবং আইনবিভাগের নিষ্ক্রিয়তার প্রেক্ষাপটে বিচারবিভাগই গণতান্ত্রিক নীতি ও আদর্শের পরম আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিজিৎবাবুর আচরণে সেই গুরুত্বের শর্ত লঙ্ঘিত হল না তো? রাজ্যের শাসক শিবিরের দুর্নীতির বিভিন্ন মামলায় বিচারপতি হিসাবে তাঁর প্রবল সম্মার্জনী চালনায় তিনি যে বহু নাগরিকের শ্রদ্ধা ও ভরসার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন, আদালত ছেড়েই কার্যত চোখের নিমেষে বিরোধী শিবিরে যোগ দেওয়ায় তাঁদের অনেকেরই মনে সন্দেহ জাগবে না তো যে, তবে কি এই পরবর্তী পদক্ষেপটির চিন্তা তাঁর পূর্বাশ্রমের সিদ্ধান্তগুলির উপর ছায়া ফেলেছিল? তিনি যে ভাষায় ক্রমাগত শাসক শিবিরকে তিরস্কার করতেন এবং সতর্কবাণী প্রচার করতেন, এমনকি রাজ্যের শিক্ষা মামলায় রাহুল গান্ধীর সম্পত্তির হিসাব চাওয়ার কথা বলেছিলেন, তার ফলে এই সন্দেহ গাঢ়তর হয় না কি? বিচারপতিদের সম্পর্কে এই ধরনের সংশয়ের লেশমাত্র থাকা বাঞ্ছনীয় নয়, অথচ এ দেশে মাঝে-মাঝেই তেমন সংশয় তৈরি হয়। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তাতে নতুন সংযোজন হয়ে উঠলে তা স্বস্তির কারণ হবে না।